গোলাম রাব্বানী
কোনো কোনো নক্ষত্র থাকে, যারা ভালো করে দ্যুতি ছড়াবার আগে চলে যায়। এই গ্রহে এমন কিছু মানুষের জন্ম হয় কখনো কখনো, যারা ওইসব চলে যাওয়া নক্ষত্রদের মতো, উজ্জ্বল আলোর সমাবেশে মানুষকে না ডাকতে ডাকতেই তাদের কণ্ঠ পাথরচাপা পড়ে যায়। তাদের স্বপ্ন আর মহারথীদের মতো তাদের দুর্নিবার স্পৃহা কালের কোনোগহ্বরে মুখ লুকিয়ে কাঁদে, যেসব ঠাওর করা আজকের এনতুন শতাব্দীর মানুষের পক্ষে কঠিন। আর কঠিন বলেই এই ২০১৯ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শেখ কামালের নাম কখনো অনুচ্চারিত আর কখনো এত নিচু স্বরে তার নাম উচ্চারিত হয় যে, বক্তার স্বগতোক্তি হয়েই নামটি বক্তার কাছেই রয়ে যায়, শ্রোতা অবধি যায় না।
অথচ শেখ কামাল ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। আমরা নতুন প্রজন্ম যখন শেখ কামালকে অনুধাবন করতে পারি একটু-আধটু, তখন বুঝতে পারি কতটুকু দ্যুতি ছিল এই তরুণের ভেতর, তার চোখের ভেতর ছিল কতটা দূর, তিনি ঠিক কতদূর দেখতেন।
এই অনেক অনেক দূর দেখতে পারা মানুষটা ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জেষ্ঠ্যপুত্র। পিতার মতোও কি তিনি মাটির মানুষ ছিলেন? পিতার মতোই কি তিনি জানতেন মানুষকে কীভাবে ভালোবাসতে হয়? দেশকে কীভাবে ভালোবাসতে হয়?
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি যখন পালিয়ে গিয়েছিলেন যুদ্ধের ময়দানে, বিশ্ববরেণ্য নেতার পুত্র হয়েও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে সেই সময় আমরা যদি কেউ তার হাঁটার সঙ্গী হতে পারতাম তাহলে হয়তো আমরা সঠিকভাবে বুঝতে পারতাম কতটা গভীর মমতায় তিনি ভালোবেসেছেন সাধারণ মানুষকে। প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হয়েও যখন তার পকেটে টাকা থাকত না, তিনি হেঁটে হেঁটে ফিরতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধানমন্ডি বত্রিশ, যখন তিনি নাটকের দলে কাজ করতেন, যখন তিনি গান গাইতেন গলা ছেড়ে, আমরা যদি এই ২০১৯ সালের নতুন মানুষেরা তখন তার বন্ধু হতাম তাহলে হয়তো সত্যিকারে বোঝা যেত কতটা শিকড়ের সাথে তার সম্পৃক্ততা ছিল।
১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। মাত্র ২৬ বছর ১০ দিন। এই খুব অল্প সময় পৃথিবীতে, বাংলাদেশে বেঁচে ছিলেন শেখ কামাল। ঘাতকের গুলিতে তার স্পন্দনমুখর জীবন নিস্পন্দ হবার আগ পর্যন্ত তিনি বেঁচেছিলেন। আধমরা হাজার হাজার কোটি কোটি মানুষের ভেতর এক আলাদা উজ্জ্বলতা হয়ে তিনি বেঁচেছিলেন। যেমন করে বেঁচে থাকলে মানুষের মতো বেঁচে থাকা যায়, মাথা উঁচু করা যায়, ঠিক সেভাবেই বেঁচেছিলেন শেখ কামাল; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র। স্বতন্ত্র মানুষ হয়ে, একদম আলাদা।
একজন মানুষ কতটা পরিপূর্ণ, কতটা স্বতন্ত্র আসলে তা বোঝা যায় তার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জ্ঞান ও দূরদর্শিতা দিয়ে। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেবার কারণে শেখ কামালের রাজনৈতিক জ্ঞান অত্যন্ত গভীর ছিল। মুক্তিযুদ্ধপূর্ব সকল আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি সক্রিয় ছিলেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হতেই তিনি পালিয়ে যান। আর সব তরুণদের মতো প্রশিক্ষণ নেন। ফিরে আসেন যুদ্ধের ময়দানে। পরবর্তীতে শেখ কামাল যুদ্ধকালীন সময়েই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তার আগে তিনি সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পরপরই তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন, ফিরে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান শিখতে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলার মাটিতে তিনি আরম্ভ করেন তারুণ্যে মোড়ানো তার একান্ত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক যাত্রা। স্বাধীনতা যুদ্ধেরও আগে যখন আইয়ুব খান তার সিংহাসন বাঁচানোর জন্য নানা কলাকৌশল করছেন, সাম্প্রদায়িকতার দোহাই দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ করেছেন তখন ২০ বছরের তরুণ শেখ কামাল এখানে-সেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে আইয়ুব খানের দিকে আঙুল তুলেছেন। তিনি যেন তার গানের ভেতর দিয়েই পিতার মতো বলছেন, ‘আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’
শেখ কামাল শত্রুর মোকাবেলা করতে ভালোবাসতেন, ভয় পেতেন না। তিনি ভালোবাসতেন গান। শেখ কামাল ছোটেবেলা থেকেই ছায়নটে সেতার শিখতেন। পরবর্তীতে তিনি স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী নামে একটা গানের দল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা থিয়েটার। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে তিনি ছিলেন নাট্যকর্মী। নাটকের প্রতি তার ভালোবাসা তাকে বারবার টেনে নিয়ে যেত মঞ্চে।
একজন প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হয়েও তিনি সবার সাথে সবার মতো করেই মিশতেন, নাটক করতেন, নাটকের রিহার্সেল শেষে সবাইকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তবে তিনি বাড়ি ফিরতেন। এই যে সাধারণ মানুষের মতো তার যে বেঁচে থাকার প্রবণতা, একদম মাটির মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা এটাই প্রমাণ করে যে, কতটা গভীর রাজনৈতিক মানুষ ছিলেন তিনি। এত তরুণ বয়সে তিনি তার হৃদয়ে কতটা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রজ্ঞা ধারণ করেছিলেন।
বাস্তবিকই তিনি ছিলেন বিস্ময়করভাবে প্রজ্ঞাবান। আর ছোটোবেলা থেকেই শেখ কামাল ছিলেন প্রচণ্ড চঞ্চল, ডানপিটে। খেলাধুলায় প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল তার। শাহীন স্কুলে থাকাকালীন সময়ে অংশগ্রহণ করতেন প্রায় সব খেলায়। কি ফুটবল, কি ক্রিকেট, কি হকি, সবকিছুতেই শেখ কামালের সরব উপস্থিতি। আর সেই সরব উপস্থিতির ফসল ছিল আশি আর নব্বইয়ের দশকজুড়ে ঢাকার ফুটবল মাঠগুলোয় কানায় কানায় দর্শক। আবাহনী আর মোহামেডানের মধুর দ্বৈরথ।
বাংলাদেশের খেলার মাঠে যে আধুনিকায়ন তা শুরু হয়, শেখ কামালের হাত ধরেই। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যুদ্ধের গোলাবারুদের মাঝে বসে তিনি যে স্বপ্ন দেখতেন, দেশে ফিরে এসেই শুরু করেন তা বাস্তবায়নের কাজ। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন আবাহনী সমাজকল্যাণ সংস্থা। সেই বছরই এ সংস্থার পক্ষ থেকে ইকবাল স্পোর্টিং ফুটবল দল কিনে নেয়া হয়। সেইসাথে কিনে নেয়া হয় ক্রিকেট আর ফুটবল টিমও। এসব দল মিলে তিনি গড়ে তোলেন আবাহনী ক্রীড়াচক্র।
শেখ কামাল চাইতেন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে একটা পাকাপোক্ত আসন করে নিক। নিরলসভাবে কাজ করে যেতেন তিনি। ১৯৭৩ সালে বিদেশি কোচ বিল হার্টকে এনে তো তিনি রীতিমত সবাইকে অবাক করে দেন। ওই সময় ক্লাব দল তো দূরের কথা, উপমহাদেশের কোনো জাতীয় ফুটবল দলের বিদেশি কোচ ছিল না। কিন্তু ওই যে বললাম না, শেখ কামাল ছিলেন একজন তুখোড় স্বাপ্নিক মানুষ। তার স্বপ্নের ডানায় ভর দিয়েই ১৯৭৪ সালে কলকাতার মানুষও দেখে আবাহনীর অসাধারণ ফুটবল নৈপুণ্য। তারা অবাক হয়ে যায় ছোট ছোট পাসের জাদুতে।
ক্রিকেটও ভালোবাসতেন তিনি। নিজেও ক্রিকেটার ছিলেন। শেখ কামাল নিখুঁত লাইন-লেন্থ মেনে বল করতে পারতেন। কিন্তু বাঙালি হবার কারণে আবদুল হালিম খান জুয়েল যেমন ছিলেন বঞ্চিত, তেমন তিনিও। স্বাধীনতার পর তিনি দেশের আনাচে কানাচ থেকে খুঁজে বের করে আনেন সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতিভাদের। ইদানীংকালে যে প্রতিভা অন্বেষণ নিয়ে মাতামাতি হয়, তারও গোড়াপত্তন করেন শেখ কামাল।
প্রশ্ন হলো, শেখ কামাল সেই তরুণ বয়সেই কেন হয়ে উঠলেন ক্রীড়াঙ্গনের পৃষ্ঠপোষক? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই নিহিত আছেন শেখ কামালের দূরদর্শিতা আর দেশের প্রতি অসীম মমতা। শেখ কামাল ওই তরুণ বয়সেই বুঝতে পেরেছিলেন জাতি গঠনে খেলাধুলার গুরুত্ব কম নয়। আর যে কয়টা জিনিস পারে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে ধরতে, তার মধ্যে এই খেলাধুলা অন্যতম। তিনি সেই ১৯৭৩-৭৪ সালে লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলবে। আজ বাংলাদেশ পাঁচটা বিশ্বকাপ খেলে ফেলেছে। কে জানে হয়তো শেখ কামাল বেঁচে থাকলে ফুটবল বিশ্বকাপেও বাংলাদেশ উঁচু করে ধরত লাল-সবুজ পতাকা।
এই লাল-সবুজ পতাকা শেখ কামাল ভালোবাসতেন খুব। এই ভালোবাসা থেকেই তিনি অর্জন করেছিলেন অসাধারণ সব গুণ। তিনি যখন ক্রীড়া সংগঠক, তখন নানা মতাদর্শের মানুষকে তিনি এক করতেন, একই ছাতার তলে আশ্রয় দিতেন। এই যে রাজনৈতিক উদারতা এটাও বিরল গুণ। এই উপমহাদেশে এ এক দুষ্প্রাপ্য খনি।
বস্তুত শেখ কামাল ছিলেন একজন বিরল প্রতিভাবান তরুণ। মাত্র ২৬ বছরের জীবনে তিনি যে আকাশের মতো বিশাল আর বিস্তৃত স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেইসব স্বপ্নের বিস্তৃতির দিকে তাকালে অবাক লাগে। যে বয়সে মানুষ হৈ-হুল্লোড় করে, জীবনের সোনালী সময়কে আরো রঙচঙ মাখিয়ে খয়েরি, বেগুনি বা গোলাপি করার চেষ্টায় মত্ত থাকে, যে বয়সে মানুষ কেবল নিজেকে নিয়েই ভাবে, সেই বয়সে তিনি কোথা থেকে পেয়েছিলেন অমিত প্রজ্ঞা? তিনি কীভাবে ধারণ করেছিলেন পাহাড়ে ওঠার বাসনা খেলা পাগল একটা পুরা জাতিকে নিয়ে?
ভাবতেই অবাক লাগে আজকে আমরা যে তরুণরা, এই আমাদের সাথে শেখ কামালের মানস জগতের কতটা পার্থক্য ছিল। পৃথিবীর যে কোনো দেশের এই সময়ের তরুণদের এমনকি সেই সময়ের তরুণদের তুলনায় মেধায়-মননে আর সৃজনশীলতায় তিনি কতটা আলাদা ছিলেন।
শেখ কামালের উদ্যম, স্পৃহা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, উদারতা, সাংস্কৃতিক মননশীলতা আর একজন প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হয়েও মাটির মানুষের মতো তার জীবনযাপন, মানুষের সাথে নিবিড়ভাবে মিশে যাওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা সবমিলিয়ে তিনি যেন নিজেই একজন রূপকথা। একজন ব্যাকবেঞ্চার কিংবদন্তি।
যে কিংবদন্তি মানুষটি স্বপ্ন দেখেছিলেন অনেক। তার চশমার কাঁচের আড়ালে যে দিগন্তবিস্তৃত খোলা মাঠের মতো চোখ ছিল তা দিয়ে অনেক অনেক দূর অবধি দেখতে পেতেন। তার প্রিয় ক্রিমকালারের শার্ট আর নেভি ব্লু শার্ট পরে তিনি সেই খোলা মাঠ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতেন অনেক অনেক দূর। আর কত কত দূর অতিক্রম্য পাহাড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখতেন তার কাফেলা নিয়ে!
আপনি যদি সেই স্বপ্নের ভেতর ঢুকে পড়েন তাহলে দেখবেন এক চশমা পরা ছিপছিপে তরুণের অবিরত সংগ্রামের আশ্চর্য সব দিনলিপি, আশ্চর্য সব গান। যেইসব গলায় তুলতে না তুলতেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা তাকে চিরদিনের জন্য স্বব্ধ করে দিল তার প্রিয় পরিবারসহ। শেখ কামাল বাংলার ইতিহাসে অন্যতম উজ্জ্বল তরুণ, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনকের জ্যেষ্ঠ পুত্র, তিনি আর ফিরলেন না। তিনি আর ফিরলেন না পৃথিবীর এই বৃহত্তম বদ্বীপে।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদ।
© All rights reserved 2000-2025 © kalerchaka.Com
Leave a Reply