“নির্বাক সফেদা গাছ ও সেই মেয়েটি”
——রিয়াজ মুস্তাফিজ
এক.
আমার সফেদা গাছ খুব ভাল লাগে। সুন্দর সুন্দর সরু পাতা, আমার অসম্ভব পছন্দ। জানো বৃষ্টির সময় সফেদা পাতাগুলো ধুয়ে গিয়ে কেমন চক চক করে।
আচ্ছা তোমাদের বাড়িতে সফেদা গাছ আছে?
বীণা আদুরে গলায় সজীবকে বলল।
সজীব- না।
বীনা এক ঝাংটায় সজীবের কাঁধ থেকে মাথাটা সরিয়ে নিয়ে বলল, আজকেই বাড়িতে সফেদা গাছ লাগাবা।
সজীব- না লাগালে?
বিণা- তোমার বাড়ী যাবোনা, তোমার সাথে কথা বলবনা। তোমাকে দেখলে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকবো।
সজীব- আর কি হবে সফেদা গাছ লাগালে?
বীণা- আরে বুদ্ধ, তোমার বউ সেজে তোমার বাড়ি গিয়ে জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখবো। বৃষ্টির নাচনে যখন সফেদা পাতা বাহারী ঢঙ্গে নাঁচবে, তখন তুমি আমার পাশে বসে চুলে খোঁপা এটে দেবে।
জো হুকুম মহারাণী বলে সজীব দু’ হাত বাড়িয়ে দিল। দূরে থাকা বীণা সব টুকু শরীর এলিয়ে দিয়ে সজীবের বুকে এঁটে রইলো।
দুই.
অনেক রাত।
অনেকবার রিং বাঁজতে ঘুম ভাঙ্গলো সজীবের। বীণার ফোন। ঘুম কাতুরে কন্ঠে ফোন রিসিভ করলো সজীব।
সজীব- ঘুম আসছেনা তোমার?
বীণা- না, তোমার কথা ভাবছি।
সজীব- পাগলামী করোনা, ঘুমাও।
বীণা- পারবোনা। আমি ঘুমাবো না। বীণার একঘেঁয়ে জবাব।
সজীব উপায় না পেয়ে বিছানা ছেড়ে ঘরের বাইরে এলো।
বাইরে তখন প্রবল জ্যোৎস্নার ছড়াছড়ি। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে সব। কথা বলার তেমন ইচ্ছা না থাকার পরেও সজী বললো, জ্যোৎস্না দেখছো আজকের?
বীণা- হুম। আচ্ছা চাদটা কেমন লাগছে আজ?
সজীব- ঠিক তোমার মত। এক্কবারে আমার হলদে পাখিটার মত। আমি চাঁদ আর তোমার জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হই। আজকের চাঁদটা গাঢ়ো হলুদ।
বীণা- এই চলো, আমরা দু’ জন হাত ধরে হেটে অনেক দূরে চলে যাই।
সজীব- চলো।
ওরা হাটতে থাকলো। গ্রামের মেঠোপথ। জমির আইল। ফড়িংয়ের ছুটোছুটি।
জ্যোৎস্না আরো হলদেটে হতে থাকে। সব কিছু ভূলে ওরা হেটেই চলে। নিঃস্তব্ধ ধরনীতে ওরা আর জ্যোৎস্না ছাড়া কিছুই থাকেনা।
হঠাৎ কিটকিট শব্দে ফোনের লাইন কেটে যায়। সম্বিৎ ফিরে পায় দুজনে।
বীণা- ফোনের ব্যালেন্স শেষ। তুমি ব্যাক দাও।।
সজীব ব্যাক দিতেই বীণা বলে, আমার গাছের খবর বলো?
সজীব- কোন গাছ? ছোট্ট করে ঝাড়ি দিয় বীণা বলে, আরে আবুল সফেদা গাছ। ঐ দিন তোমাদের বাড়ি লাগিয়েছো যেটা?
সজীব- ও একটু একটু করে বড় হচ্ছে।
বীণা- যত্ন নেবে। যেমন করে আমার যত্ন নাও।
সজীব- আচ্ছা হলুদ টিয়া।
জ্যোৎস্নার চাঁদ পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। গাছ গাছালির ছায়াও পুবের দিকে দীর্ঘতর হচ্ছে। ফিস ফিস করে গভীর রাতের ফোনের ভালাবাসাও এগোচ্ছে তরতর করে।
দু’জনের চোখেই ঘুম ঘুম ভাব। বীণার কথার উত্তর দিতে সজীবেরএকটু দেরী হওয়ায় কেঁদে ফেলে বীনা।
– আমার কথা তোমার ভাল লাগেনা। আমি এত কষ্ট করে রাত জেগে তোমার সাথে কথা বলি, আর তুমি ঘুমাও। আমাকে তোমার আর ভাল লাগেনা। তুমি ঘুম নিয়েই ব্যস্ত থাকো। তুমি আরো ঘুমাও। এক নিঃশ্বাসে বলে চলে বীণা। মাঝপথে সজীব কিছু বলতে চাইলে বলতে না দিয়ে ও বলতেই লাগলো।
শুনো, তোমার সাথে ছাড়া কারো সাথে জ্যোৎস্না দেখবো না। আমার পাশে বসে তুমি ছাড়া অন্য কেউ বৃষ্টি দেখার সুযোগও পাবেনা। আমার সমস্ত পৃথিবী তুমি। বীণা বলেই চলে আর কাঁদে। এক সময় কান্না আরো বেড়ে যাই ওর। গোঙ্গানীর মত আওয়াজ করে ও বলে, কাফনের কাপড় না পরানো পর্যন্ত কেউ তোমার সাথে আমার কথা বলা বন্ধ করতে পারবে না।
তিন.
এভাবেই খুনসুটি, সংসারের স্বপ্ন, সুস্থ্যতা, অসুস্থ্যতা, কান্নাকাটি, মান অভিমানের ভিতর দিয়ে জমাট বাঁধতে থাকে ওদের ভালবাসার দিনপঞ্জি। লম্বা হতে থাকে ওদের ফোনে ফিসফিস করে কথা বলে রাত জাগার পালা।
সজীব বীণার অবুঝ পিরীতির ছায়া ধরে বড় হতে থাকে সেই সফেদা গাছ। বেশ বড়। সরু পাতাগুলো আরো লম্বা হয়। ডালপালা ছড়িয়ে চারিদিকে মেলে যায় গাছটি। প্রতিটি পাতায় পাতায় জড়িয়ে থাকে ওদের ভালবাসা। বিশ্বাসের বাতাসে বেড়ে ওঠে দু’জনার প্রিয় সফেদা গাছ।
চার.
হঠাৎ একদিন।
রাত জাগা হলুদ পাখি বীণা কিচ্ছু না বলে চলে যায় অচেনা মানুষের ঘরে। বীণার চলে যাওয়ায় সজীবের মত নির্বাক হয়ে যায় সফেদা গাছটাও। বীণার চলে যাওয়া পথের ধুলো এসে পড়ে নিঃস্তব্ধ সফেদা গাছের ওপর। পৃথিবীর কোন বৃষ্টিই আর ধুয়ে দেয়না সরু সফেদা পাতার জমে থাকা ধুলো।
বিশ্বাসী ডাল ভেঙ্গে সজীবের মতই বাকরুদ্ধ হয়ে যায় সফেদা গাছটিও।
নির্লীপ্ত সজীব আজো জ্যোৎস্না দেখে, সেই জানালার পাসে বসে। সেই অবহেলার সফেদা গাছটির কয়েকটা সরুপাতা সজীবের জানালার খুব কাছে এসে পড়েছে।
সজীব খেয়াল করে দেখতে পায়।
সফেদা গাছটিতে নতুন করে কুঁড়ি জন্মেছে। সে কুঁড়িতো বিশ্বাস ভঙ্গের শিরা উপশিরায় লাল রংয়ের হাহাকার মাখানো।
এখনো ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় সফেদা গাছটার ডালপালা, কুড়ি, ব্যাঙ্গর চিৎকারে ফেটে পড়ে।
এভাবে আরো ঘৃণা, বিদ্বেষ আর প্রতারনার স্মৃতি নিয়ে বড় হয় নির্বাক নীল সফেদা গাছ।
আরো বড়ো…..
© All rights reserved 2000-2023 © kalerchaka.Com
Leave a Reply