“মায়ের চোখে মুক্তিযুদ্ধ” —-রিয়াজ মুস্তাফিজ
১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। মায়ের বয়স তখন ৮/৯।আলফাডাঙ্গার বারাংকুলা গ্রামের খান বাড়ির আদরের ছোট মেয়ে আমার মা। তদানিন্তন পাকিস্থানী বাহিনী এ দেশে কি নির্মম অত্যাচার করেছিল সে দিনগুলোতে, মায়ের মুখে প্রায়ই সে গল্প শুনি আমরা ক ভাই বোন। মায়ের শৈশবের ভয়াবহ ৭১ এর স্মৃতি যতই শুনি, ততই শিহরিত হই। সে দিনের সেই ৮/৯ বছরের শৈশব মাড়ানো ছোট্ট মেয়েটি কিইবা দেখেছে ৭১ এর নির্মমতা। কিছু দেখা আর কিছু শোনা কথাগুলোই আজ স্তম্ভিতকরে দেয় আমাদের।
আমার নানা বেঁচে ছিলেন না। নানি শত কষ্টের মধ্যেও ৩ ছেলে ৩ মেয়ের সংসার আগলে রেখে ছিলেন পরম মমতায়। এর মধ্যেই দরজায় কড়া নাড়ে ৭১ নামের ভয়াল পশ্চিমা দূর্যোগ।নানি রান্না নিয়ে ব্যস্ত। তিন মেয়ে নানির পাশেই ছিল। মামারা বাড়ির পালানের সুপারি পাড়া নিয়ে ব্যস্ত।এখন মায়ের মুখ থেকে শুনবো……..হঠাৎ বিকট গোলাগুলির শব্দ শুনে চিৎকার দিয়ে উঠি। মাকে জড়িয়ে ধরি তিন বোন। কিছুই বুঝে ওঠার আগেই সেজো ভাই আমাকে একহাতে উচু করে ধরে অন্য দুই বোনদের নিয়ে বাড়ির পাশে বাগানের দিকে দৌড় দেয়। বাগানের বড় গাছের আড়ালে মাথা নিচু করে থাকতে বলে। বাড়ির অন্যান্য সবাই ঘরের ডোয়ার পাশে শুয়ে পড়ে। চটপট করে গুলির আওয়াজ আসছে চারদিক দিয়ে। মনে হচ্ছে কানের পাশ দিয়ে সা সা করে ছুটে যাচ্ছে গুলি,,,,গুলির সাথে শুরু হলো বৃষ্টি ও দুমদাম বজ্রপাত। কিছুই বুঝে ওঠা যাচ্ছিল না। চারিদিকে ধোঁয়াশা, এর মাঝেই গুরিবিদ্ধ হয়ে মারা যান আমার এক চাচী। উদ্ভট উদ্ভ্রান্ত পরিস্তির মাঝে বড় ভাবি ছেলে সন্তান প্রসব করে।আমার মা বলে যাচ্ছিলেন এভাবেই শিরগ্রাম গোরস্থানের প্রতিরোধ যুদ্ধের কথা।
শেষ পর্যন্ত গোলাগুলি বন্ধ হলো। ভাই বোন মা মিলে নৌকায় করে হেলেঞ্চাহাটি চলে আসি। ডা: সানোয়ার হোসেনের বাড়ি। বারাংকুরা গ্রামের অনেক লোক এ বাড়িতে আস্রয় নিয়েছে। সে সময় বড় আপাকে নিয়ে সবাই খুব দুশ্চিন্তায় ছিল।ডাঃ সানোয়ারের বাড়িতে তাবালে করে ভাত রান্না হত। আশে পাশের আশ্রয়হীন মানুষগুলোর এ বাড়িত ঠাঁই হয়েছিল।কিছুদিন পর বাড়ি চলে আসি। বাড়ি আর বাড়ি নেই, হাস মুরগি গরু ছাগল কিছুই নেই। জানতে পারি মুক্তিযোদ্ধা ছালাম খাঁ পাকিস্থানিদের লঞ্চ আ্যাটাক করেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদেরগুলি ফুরিয়ে যাওয়ায়পিছু হটতে বাধ্য হয় তাঁরা।কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটলেও পাকিস্থানিদের লঞ্চের ইঞ্জিন রুম ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পাক বাহিনী চৈড় দিয়ে বেয়ে ভাটিয়াপাড়ার দিকে চলে যায়।পাল বাড়ির কেউ কেউ ইন্ডিয়া চলে যায়।
যে যেখানে পারে আত্বগোপন করে থাকে। সব চেয়ে বেশি ভয়ে থাকতো পাল বাড়ির লোকজন। পাল বাড়ির অনেকেই আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিত মাঝে মধ্যে।মায়ের কন্ঠ ভারী হয়ে উঠতে লাগলো।
শত শত লাশ ভেসে গেছে ভরা বারাশিয়া দিয়ে। একদিন সন্ধ্যার সময় বারাশিয়ার পাড়ে একটি ছোট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনি। কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে…. “মা আমি আর ভাত খাতি চাবোনা। আমারে ফেলায় যাইওনা। আমারে নিয়ে যাও মা….
“সবাই ঘর থেকে বাইরে এসে আর দেখলাম না। কান্নার আওয়াজ ততক্ষনে বন্ধ হয়ে গেছে। বারাশিয়ার পানি তাকে এতক্ষনে অনেক দুরে নিয়ে গেছে। মায়ের কাছে ছোট্ট বাবুটির আঁকুতি আর পৌছাবেনা কোন দিন। কোন দিন তার ভাতের খিদে লাগবেনা।প্রশ্ন রেখে গেলাম, মা তার কোলের সন্তানকে কখন ফেলে চলে যায়?এর উত্তর ৭১ এর দিকে তাকালেই পাওয়া যাবে!
মা বলেই যাচ্ছেন……বারাশিয়ার পাশেই কানা বিল। বান্ধবীরা মিলে শাপলা তুলতে যাই বিলে। হঠাৎ একটা লাশের গায়ে পা পড়ে যায় আমার। বজ বজ করে ওঠে রক্ত মাংস। ভয়ংকর চিৎকার দিয়ে কোন মতে ডাঙায় উঠে আসি। স্বাভাবিক হওয়ার পর গ্রামের মানুষদের নিয়ে লাশের কাছে যাই। সবাই চিনতে পারে লাশটিকে,,,, আমাদের গ্রামের আফজাল। বেশ কিছুদিন ধরেই নিঁখোজ ছিলো সে।গ্রামে নুর খাঁর বাড়িতে নোংগর খানা ছিল। সেখানে মাঝে মধ্যে ভাল খাবার (খিচুড়ি) জুটতো। কলার থৈড়,কচুর খাটা, আটা গুলানো,গমের ভাত এগুলো খেয়েই কোন মতে দিন কাটছিল।
অনেককেই দেখেছি নুর খাঁর বাড়ির ভাতের মাড়ের জন্য দাড়িয়ে থাকতে। নোংগর খানাও মাঝে মধ্যে বন্ধ থাকতো। নকশালরা নাকি হত্যার হুমকি দিয়ে চিঠি লিখতো নুরখাঁকে। আমার ৮/৯ বছর বয়সের সেই মায়ের শৈশব স্মৃতিতে ৭১ এ এর চেয়ে বেশি কিছু মনে নেই। মা এখন তাঁর নাতি পুতিদের রুপকথার গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ান। ওরা এখনো জানে না মুক্তিযুদ্ধ কি? হয়তো কিছুদিনের মধ্যে জানতে চাইবে ওরা।ওদেরকে আমার মা এই গল্পটাই শুনাবেন। ওরা শুনবে আর বড় হবে। একদিন জেনে যাবেই মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ কি।আমার মা এখনো কেঁপে কেঁপে ওঠেন। ফেলে আসা ৭১ ভয় ধরিয়ে দেয় এখনো। এখনো হয়তো আনমনে স্মৃতি হাতড়ে শুনতে পান, কোন এক সন্ধ্যে রাতে বারাশিয়া পাড়ের ছোট্ট শিশুর বিলাপ…..!
“আমারে ফেলায় যাইওনা মা আমি আর ভাত খাতি চাবো না। আমারে নিয়ে যাও মা”।।
© All rights reserved 2000-2023 © kalerchaka.Com
Leave a Reply