“মাতুব্বরী তত্ত্ব” —–রিয়াজ মুস্তাফিজ
গ্রামের শালিস মিটিংকে আমি সব সময় সম্মান করি। গ্রাম সমাজের ছোট বড় সব ধরনের সমস্যা শালিসের মাধ্যমে সমাধান করা হয়।
এ ক্ষেত্রে নাম্বার ১ ক্লাসের মাতুব্বরেরা সততার সাথে বিচার করে থাকেন। তাই গ্রামে শান্তি শৃংখলা বজায় থাকে।
টাকা খাওয়া, খুচা মারা মাতুব্বরগন শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে চরম অশান্তি সৃষ্টি করেন। এদেরকে ক্রিমিনাল ক্লিকবাজ মাতুব্বর বললেও দোষ হবে বলে আমার মনে হয় না।
উদার, শান্তিপ্রিয় মাতুব্বরগন নিজের পকেটের টাকা দিয়ে হলেও গ্রামের শান্তি বজায় রাখেন। গোলার ধান, বাজার করার পকেটের টাকা দিয়ে দিতেও আমি দেখেছি। এ ধরনের মাতুব্বগন সব সময় অভাবে থাকেন।
পক্ষান্তরে, কথা চালাচালি, ছোট কথা বড় করে চালান দিয়ে গ্রামের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করেন একশ্রেনীর উস্কানীদাতা মাতুব্বরেরা। ফলে লাঠালাঠি, ফাটাফাটি বেঁধে যায়। দুই দলের রোগী ভর্তি হয় হাসপাতালে।
এ সময় হাসপাতালে দর্শনার্থীর ভিড় বেড়ে যায়। হাসপাতালে থাকা বেশির ভাগ রোগীই মাথা ফাটা হাড় ভাঙ্গা। হাসপাতালের ভিড় সামলাতে নার্সরা হিমশিম খেয়ে বকাঝকা শুরু করেন। এমাতবস্থায় হাসপাতাল গরম হয়ে যায়। গরম হয় থানা। এক শ্রেনীর মাতুব্বরগন উচ্চ মহলে তৎবিরবাজি করে থানা নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করে থাকেন।
হাসপাতারের সামনের কলা রুটির দোকানে বেচাকেনা বেড়ে যায় বহুগুনে। নগদ বাকি মিলিয়ে ঔষুধের দোকানে ভাল বেচাবিক্রি হয়। ঔষুধ কোম্পানির লোকেরা রোগীর প্রেসক্রিপশান নিয়ে টানাহেচড়া করে। রিপ্রেজেন্টেটিফ দেখেন তাদের ঔষুধ কমিশন ভোগী ডাক্তার লিখলো কিনা। এ সময় রোগীর আত্বীয় সজনেরা ঝাড়ি মেরে প্রেসক্রিপ্শান নিয়ে যান রিপ্রেজেন্টেটিফদের কাছ থেকে।
ঝাড়াঝাড়ি চলতে থাকে থানায়ও। মামলা হলে থানার সামনে খুব ভীড় হয়। চায়ের দোকানগুলোর দুধের সর আরো গরম হয়। এ গরম গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে। আসামিরা পার্শ্ববর্তি আত্বীয়ের বাড়ি আত্বগোপন করে। আসামির তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার জন্য (ইনভেলাপ) হাতে অনেকেই ঘুরাঘুরি করেন।
চায়ের কাপে ঝড়, সুনামি, ফনি, সাইক্লোন উঠে যায় এ সময়। চাপাবাজি, কুটলামি, ক্ষমতার ব্যবহার, অপব্যবহার এ সময় চাক্ষস দেখা যায়।
ইদানিং কালের শালিস ব্যবস্থায় দুই পক্ষের মাতুব্বরগন নেমে পড়েন টাকা খাওয়ার ধান্ধায়। চেয়ারম্যান, মেম্বার কেউ এ দরের বাইরে নয়।
কিছু মাতুব্বরগন টাকা পয়সা ছাড়াই নিঃস্বার্থ মানুষের উপকারে আসেন। কিন্তু চা সিগারেট বিড়ি পান জর্দা খাওয়া বাধ্যতামূলক হয়ে দাড়ায়। গ্রামের হতদরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষদের উপরে মাতুব্বরীর প্রভাব বেশি পড়ে।
২ নাম্বার টাইপের মাতুব্বরদের খেয়ে কোন কাজ থাকেনা। পরের কাজের ক্ষতি করতে এরা ওস্তাদ। অন্যের পকেটের টাকায় এদের গালের চর্বিতচর্বন চলতে থাকে বছরের পর বছর। এ গোছের মানুষ গুলো দেশের তেমন খবর রাখেনা। তর্ক করে জিতে যাওয়া এদের চিরায়িত বদ অভ্যাস। কথায় কথায় হুমকি, লাঠি,সোটা, দা, সড়কি এদের কাছ থেকেই পাওয়া যায়।
এই শ্রেনীর মাতুব্বরগন হাদিস, কোরআন না জেনেই বিভিন্ন ফতোয়া দিয়ে থাকেন। যেমন জিনার বিচার, বউ ছাড়া, হিল্লে বিয়ে, একঘরে করে রাখা ইত্যাদি।
ভিলেজ পলিটিক্সের চোগলখোর মাতুব্বরদের চামচার অভাব থাকেনা। বিভিন্ন শালিস মিটিংয়ে জ্বি….জ্বি মাতুব্বর সাব উচ্চারন শোনা যায় অহরহ।
২ নাম্বারের ভন্ড প্রকৃতির মাতুব্বরগন আসলে কোন পক্ষের তা বুঝতে গেলে পাগল হয়ে যেতে হয়। এরা সকল পক্ষের লোকের কাছে ভাল সেজে থাকেন।
আমাদের গ্রামে কোরবানীর গোস্ত দলীয় নেতাদের বাড়ি জমা করে নাম ডেকে ডেকে বিলি করা হয়। এটাই আমার গ্রামের নিয়ম। জন্মের পর থেকে দেখে আসছি!
অবশ্য একদলের লোক অন্য দলের নেতার বাড়ি গোস্তের জন্যে যায় না। ( দলীয় কোরবানী)
অশিক্ষীত, অল্প শিক্ষীত, ধর্মীয় গোড়ামী, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এক শ্রেনীর মাতুব্বরের সংখ্যা দিন দিন ভয়ানক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে কিছু ভাল মানুষ, মাতুব্বর, সমাজপতি এখনো আছেন। তাদের সংখ্যা একেবারেই কম। গ্রামীন সমাজ ব্যাবস্থা তাঁদের জন্যে টিকে আছে বলে আমার মনে হয়।
গ্রামের উন্নয়নে, শিক্ষা বিস্তার, বাল্য বিবাহরোধ, বেকারত্ব দূর, নারী শিক্ষার প্রসার সহ জনহিতকর কাজে এদের মন থাকেনা। কার ছাগলে কার বেড়া ভেঙ্গে কি খেয়ে ফেলল…….. এই নিয়ে তারা ব্যস্ত থাকেন।
আমরা “কন্ট্রাক মানির” মাতুব্বরী চাইনা। গ্রামের শালিস ব্যবস্থায় সুশিক্ষীত, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, উদার মানসিকতার মানুষ চাই। যাদের হাত ধরে এগিয়ে যাবে গ্রাম, গ্রামের পর গ্রাম…….. এগিয়ে যাবে আমাদের গ্রাম প্রধান বাংলাদেশ।
© All rights reserved 2000-2025 © kalerchaka.Com
Leave a Reply