‘কে আর পাশে দাঁড়ায়
ঢেউহীন নদীগুলো
শুকনো জনপদে
একা একা মরে গেছে।’
শেষ সময়কে হয়তো আগেই টের পেয়েছিলেন শ্লোগানের কবি নাজমুল হক নজীর।তাই তো জীবদ্দশায় শেষ কাব্যগ্রন্থ ভিটেমাটি স্বরগ্রাম’ এর “ফেরা” কবিতায় এমন আত্মাভিমানী উচ্চারণ করেছিলেন তিনি।
বরেণ্য এ কবি ও সাংবাদিকের আজ ৪র্থ প্রয়াণ বার্ষিকী,২০১৫ সালের ২৩শে নভেম্বর রাজধানী ঢাকাতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে পাড়ি জামান অনন্তের পথে।ত্রিশোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতায় নাজমুল হক নজীর একজন স্বতন্ত্র কাব্যসাহসী আধুনিক কবি। ১৯৫৫ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার শিয়ালদী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
একজন কবিকে সময়ের প্রয়োজনে কবিতা আর কলমকে করতে হয় প্রতিবাদের হাতিয়ার,কথা বলতে হয় প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়ে,একজন সময় সচেতন কবি হিসেবে নাজমুল হক নজীরের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।১৯৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনীতির যে টানাপোড়ন দেখা দেয়, বাংলাদেশ হাঁটতে থাকে অন্ধকারের পথে, ঠিক সে সময়ে কবি ‘প্রেমের দাবিতে বলছি’ কবিতায় লেখেন- ‘পতাকা দুলছে বুনো হাওয়ায়/নেতা যাচ্ছে শহীদ মিনারে/ঘোষণা হতে আর কতোক্ষণ/মীর জাফর জিন্দাবাদ মীর জাফর জিন্দাবাদ!বঙ্গভবনে আজ যতো শকুনের আনাগোনা/কাকের প্রিয় বিপনি বিতান/কপট পরেছে আজ মানুষের ছদ্মবেশ/এ রাত ভোর হবে/কোথাও নেই সেই অঙ্গীকার।
সমাজের নানা অবক্ষয়ের অক্টোপাসে আচ্ছন্নতায় ব্যথিত হয়ে তার ‘ভোর হতে আর কতক্ষণ’ কবিতায় লেখা হয়ে যায়- ‘আজ অমাবস্যা- পূর্ণিমায় রবীন্দ্র চুরি যায়/নজরুল হচ্ছে গনছিনতাই/পূর্ণিমা চাঁদ পোড়া রুটি ভেবে ভেবে/কাঁদে সে সুকান্ত বালক।কমরেড এই দেশে ভোর হতে আর কতোক্ষণ/ধর্ষিতা আজ ডাঃ লুৎফুর রহমানের উন্নত জীবন/শরৎচন্দ্র হয়ে যাচ্ছে সুন্দর চরিত্রহীন/আর কুরুক্ষেত্র আজ/জসিমউদদীনের নকশী কাঁথার মাঠ/এদেশের কবিরা এখন শব্দ পতিতা বুদ্ধিজীবীরা গোহাটার দালাল/নেতাজীরা তুখোড় বাচাল/পাঁচ আঙ্গুলে ঠেলে আমলারা কলম/কমরেড এই দেশে ভোর হতে আর কতোক্ষণ।
এমন স্পষ্ট কথা তিনি তার অনেক কবিতায় বলেছেন। কবিতায় কথা বলেছেন বাংলায় অপরূপ সৌন্দর্য প্রেম বিরহ কিংবা নারী বিষয়ে।একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এই কবি আত্মকথনের ন্যায় কবিতায় তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা।
কবি’র লেখা আয়নায় আপন অবয়ব,নোনা জলের বাসিন্দা, ভোর হতে আর কতোক্ষণ,প্রেমের দাবিতে বলছি,বাঙালির ছাড়পত্র অনন্যারর জন্য গীতি কাব্য কবিতাগুলো আজও কবিতার পাঠককে আন্দোলিত করে ।কবি’র সবচেয়ে আলোচিত কাব্যগ্রন্থ ‘নোনা জলের বাসিন্দা’। এছাড়াও স্বৈরিণী স্বদেশ,কালো জোছনার এক চুমুক,কার কাছে বলে যাই,ঘুরে দাঁড়াই স্বপ্ন পুরুষ,স্বপ্ন বাড়ি অবিরাম,এভাবে অবাধ্য রঙিন,ভিটেমাটি স্বরগ্রাম প্রভৃতি তার কাব্যগ্রন্থ।সাধনার ফসল,আবার শ্লোগান,ইষ্টি কুটুম মিষ্টি কুটুম কবি’র ছড়ার বই।কবির সম্পাদিত গ্রন্থ- গাজী খোরশেদুজ্জামানের কিশোর কবিতা।ফরিদপুর অঞ্চলের ইতিহাস বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থ- ‘আমাদের ফরিদপুর-১ অঞ্চল’।
কবি’র ৯টি কাব্যগ্রন্থ, ৩টি ছড়া, ১টি ইতিহাস গ্রন্থ, ১টি সম্পাদিত গ্রন্থ, নির্বাচিত কবিতা ও কবিতা সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে।সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীদের মধ্যে মতুয়া মতবাদে অনুসারীগণের জন্য কবি বেশকিছু গান লিখেছেন।
জীবদ্দশায় কবি’র শ্রেষ্ঠ সম্মাননা- ভারত থেকে রাহিলা সাহিত্য পুরস্কার। এছাড়া পেয়েছেন কবি শামসুর রাহমান স্মৃতি পুরস্কার, কবি খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার, কবি গোবিন্দ চন্দ্র দাস স্মৃতি পদক,শ্রী হরিদর্শন পুরস্কার, আমীর প্রকাশন সাহিত্য পুরস্কার,গীতিকার ক্লাব সম্মাননা, এশিয়া ছিন্নমূল মানবাধিকার বাস্তবায়ন ফাউন্ডেশন সম্মাননা, মেরিট অব ডিএক্স পুরস্কার,নির্ণয় কবি বাবু ফরিদী স্মৃতি পদক,মির্জা আবুল হোসেন পদক ও পাঠক আন্দোলন বাংলাদেশ সাহিত্য পুরস্কার (মরনোত্তর) প্রভৃতি।
প্রিয় এই কবি ২০১৫ সালের ২৩শে নভেম্বর ঢাকায় প্রয়াত হন।পরদিন কবিকে তার চেনা জনপদ কবির বাসস্থান ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার ঝর্ণাধারায় সমাহিত করা হয়।
© All rights reserved 2000-2023 © kalerchaka.Com
Leave a Reply