বিনোদন ডেক্স : বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে একটা খাল।খালের পাড়েই বেত বাগানে ঘেরা সুনশান শশ্মান। শশ্মানের ঠিক মাঝখানে একটা হিজল গাছ। একটু দূরেই ছোট্ট একটি গ্রাম। গ্রাম থেকে হিজল গাছটা স্পষ্টই দেখা যায়। শুধু দেখা যায় না প্রকাণ্ড হিজল গাছটার ভিতরে লুকায়িত ভয়াবহ ভৌতিকতা।
এই গ্রামটার সাত (৭) বছর বয়স্ক একটা শ্যামবর্ণের ছেলের সাথে হিজল গাছটার খুব সখ্য। ভরা বর্ষায় চারিদিকে যখন অতলপানি, হঠাৎ করে ছেলেটাকে পাওয়া যায় হিজল গাছের মগডালে। যে ডাল পাখির ভরও সইতে পারে না। আর ছোট্ট ছেলেটি সেই ছোট্ট ডালে দিব্যি বসে আছে। মা – বাবা নৌকা নিয়ে ছেলেটিকে গাছ থেকে নামিয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু ওর শরীরে একফোঁটা পানিও নেই। এর আগে তাকে প্রচুর বৃষ্টির মধ্যেও হিজল তলা থেকে নিয়ে এসেছে ছেলেটির মা বাবা।কিন্তু ওর শ্যাম বর্ণের শরীরের কোথাও কখনো ভেজেনা।
হিজল গাছটার বড় চারটা ডাল,সাপের ফণা মেলে চারদিকে ঝুকে থাকে। শুকনোর সময় মাটি ছাড়া চারহাত উপরে থাকে ডাল।আবার যখন বর্ষায় পানি মাঠ,খাল শশ্মান তলিয়ে দেয়,তখনও পানি ছাড়া চারহাত উপরেই থাকে হিজল গাছের ডাল।
শশ্মানের ওখানের চারিধারে আবাদি জমি।মৌসুমের সময় কৃষানেরা ভরদুপুরে নানান শব্দ শুনতে পান।হাড় ভাঙ্গার শব্দ, গোঙ্গানির শব্দ , খিলখিল হাসি, মায়াকান্নার মায়াবী ডাক।কৃষানেরা কান দেয় না এ দিকে। ভয়ে শুকনো কাঠ হয়েও সকল কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে যায় ওরা।
গ্রামের ছোট্ট ছেলেটা রাত ১২ টার পরে এখানে আসে চুপিচুপি। তার হাতে থাকে কাচা মাংস,তাজা মাছ,আরও কত ফলমূল। ছেলেটার হাত থেকে নিয়ে কচকচ করে মাংস খেতে থাকে শূন্যে ভেসে থাকা কিছু ছায়া।হুড়মুড় শব্দে ভরে যায় পুরো হিজল তলার শশ্মান। ওর বয়সী অনেক ছেলে ওকে ঘিরে চারপাশে।ঝুমুরের তালে নাচ ওঠায় ওরা। ওদের কারো শরীরে মাংস নেই।শুধু চোখের কোটায় বর্ণিল আলো ছাড়া।অনেকগুলি মাথার খুলি নিয়ে গড়াগড়ি খেলে মাংসহীন ছেলেগুলো।খুশি হয় শ্যামবর্ণের পাশের গ্রামের ছোট্ট ছেলেটা।
কিছুদিন যেতেই গ্রামের কিছু মানুষ বেত ঝাড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।বেতঝাড় পুড়ে যায় আগুনের লেলিহান শিখায়। কিছুটা পুড়ে যায় রহস্য ঘেরা হিজল গাছও। সব ধকল সয়ে সুস্থ্য হতে থাকে হিজল গাছটা ধীরে ধীরে। আর অসুস্থ্য হতে থাকে সেই লোকগুলোও ধীরে ধীরে।যেদিন হিজল গাছ সুস্থ্য হয়ে সজীব হয়ে ওঠে।সেইদিন আগুন দেওয়া দলের লোকগুলো মারা যায়। ছোট্ট ছেলেটি সে দিন ওদের বাধা দিয়েছিল কিন্তু ওর কথা কেউ শোনেনি।
এরপরে কেউ একজন ঘেন্নায় প্রস্রাব করে দেয় গাছের গোড়ায়।কয়েক ঘন্টা যেতেই লোকটার প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায়।নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় লোকটার।কয়েক ঘন্টা যেতেই মারা যায় লোকটা।এই লোকটাকেও বাধা দিয়ে ছিল, সেও শোনেনি ছোট্ট ছেলেটার কথা ।
শহর থেকে লোক আসে সর্বনাশা হিজল গাছটা কাটতে।করাত দিয়ে কয়েক টান দিতেই গাছের গোড়া থেকে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসে।ছিটকে বেরিয়ে যায় দূরে।কান্নার আওয়াজ আসে গাছের প্রতিটি পাতা থেকে। যেন হাজারো রমনী সুর করে কেঁদে উঠেছে।শহরের লোকজন গুলো ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় কেউ। কেউ করজোড়ে মাপ চেয়ে কাঁপতে থাকে হিজল তলায়।
হঠাৎ কয়েকদিন পরেই চারদিকে কালো মেঘে ছেয়ে যায়।অজস্র বজ্রের শব্দে প্রকম্পিত হয় চারিদিক। এক ঝংকারে সমস্ত পাতা ঝড়ে পড়ে। বৃষ্টির ঝনঝনির সাথে।সাপের ফণা মেলা চারটি ডাল হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে তলায়।গাছটির গুড়ি কটকট শব্দে ছিটকে পড়ে খালের পানিতে।এরপর ভেসে যায় দূরে, বহুদূরে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় হিজলের ছায়া।
হিজল গাছের সাথে সখ্য গড়ে তোলা ছেলেটি আর শশ্মান মুখি হয় না।ওর মন খুব খারাপ।
এভাবেই কেটে যায় ২০টি বছর। ছোট্ট ছেলেটি এখন অনেক বড় হয়েছে।ঘর গৃহস্থালি করছে।শশ্মান ঘাটের হিজল গাছের কথা এর আর মনে পড়ে না।
একদিন শশ্মান ঘাঠের কাছে ওর জমির কাজ করতে যায় সেদিনের ছোট্র ছেলেটি,যে আজ পরিপূর্ণ যুবক ।কাজের ফাঁকে আনমনে দেখতে পায় ছোট্ট আর একটি হিজল গাছের চারা। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া গাছটির একটু পশ্চিমে জন্মেছে। আবার ছোট গাছটি,এ গাছেরও চারদিকে চারটা ডাল সাপের ফণার মত ফণা তুলে আছে।ও আরো দেখতে পায় ছোট্ট হিজল গাছটির পাশে ছোট্ট আর একটি ছেলে বসে আছে চুপটি মেরে। বড় অপেক্ষায়,বড় তৃষ্ণায়…..ঠিক ওর মত ৭ বছরের সেই ছেলেবেলার শ্যাম বর্ণের চেহারা নিয়ে।
© All rights reserved 2000-2025 © kalerchaka.Com
Leave a Reply