এম.এম.লিয়াকত হোসেন ( লিটন ) :
——————————————————–
চৈত্র মাসের তাপদাহ/ গরমের এক রাতে আমরা পরিবারের সবাই উঠানে খেজুর পাতার পাটিতে বসে পল্লীগানের অনুষ্ঠান (বাসরী) এবং মধুমালার কিচ্ছা শুনছি। সারাদিনের টাঠা পড়া রোদে মাটি হতে কেমন যেন একটা ভাঁপসা পোড়া গন্ধ বেরোচ্ছে। গরমে ঘেমে অস্থির অবস্হা। মা তালপাখা ঘুরাচ্ছে। তবে ভাল লাগছে চাঁদ যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে জোৎস্নার হাসিতে হাসছে। অন্য রকম এক অনুভূতি কাজ করছে হৃদয় ও মননে……..
এর মধ্যে বিদ্যুৎ চমকানোর মত বিজলীর হাসিতে আমরা আকাশ পানে তাকালাম। দেখলাম কি যেন একটা ছায়ার মত পাখাওয়ালা উড়ে যাচ্ছে। আমরা কেমন যেন থমকে গেলাম কথার মাঝে এবং সারা শরীর শিহরিত ও ভয় ভয় লাগছে………
বাবা বললো, আরে ওর নাম ” ইরা পরী ” আমরা কত দেখেছি ওকে।ও আমাদের কোন ক্ষতি করেনা। ওর পরনের শাড়ী যখন ছুটে যায়, তখন বিজলীর মত একটা আলোকছটা হয়। মন্ত্রমুগ্ধের মত বাবার কল্পকথা শুনছিলাম মা সহ আমরা ভাইবোন……….
হঠাৎ কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল। জোৎস্না ও চাঁদ হারিয়ে গেল মেঘের আড়ালে। গুড়ুম গুড়ুম করে প্রচন্ড বেগে মেঘ তার চিরাচরিত নিয়মে চিৎকার শুরু করল। ঝপ ঝপ করে কয়েক ফোটা বৃষ্টির আগমনি বার্তা শরীরে পড়ল। আমরা খেজুর পাটি নিয়ে দৌড়ে খাবার ঘরের বারান্দায় এসে পাটি বিছিয়ে বসে পড়লাম। মা ঘরে গেল রাতের খাবার বেড়ে আনতে………..
বাহিরে মেঘের বিদ্যুতের বিজলী আর বারান্দায় হারিকেনের আলোতে সবাইকে যেন ঝলমলে লাগছে। বাবার দিকে তাকালাম, বাবার মুখখানা কেমন যেন মলিন ও ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। বাবার চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।বাবাকে বললাম, বাবা কাঁদছো কেন? কি হয়েছে তোমার?
বাবা কোন জবাব দেয়না। শুধু ফুফিয়ে ফুফিয়ে ঢুঁকরে উঠছে আর ঠোঁটটা ডান দিকে খানিকটা বাঁকা হয়ে যাচ্ছে।বুঝতে বাকি রইলনা, বাবার মনে হয়ত কোন কষ্টের হাট বসেছে, চলছে ব্যথার বিকিকিনি।
খানিক বাদে কাঁপা কাঁপা ঠোটে কান্না জড়িত কন্ঠে বাবা নিজেই বলতে শুরু করলেন।
শোন তবেঃ—–
তখন ১৯৭১ সাল।আমাদের দেশে নেমে এলো এক ভয়াল চিত্র। পশ্চিমারা আমাদের বাঙ্গালীর উপর ঝাপিয়ে পড়ল।শুরু করল অন্যায়, অবিচার,জুলুম, খুন। আমি তখন হাই স্কুলে পড়ি।পাক বাহিনী মা – বোনদের ধরে নিয়ে তাদের ইজ্জত হরন করতে লাগল।নিরিহ বাঙ্গালীর উপর নির্বিচারে শুরু করল গুলী বর্ষন। কত মানুষ মরল।বাড়ি ঘরে আগুন ধরিয়ে দিল।
আর এই রকম মেঘের তর্জন গর্জনের মত গুলীর আওয়াজ শুনতাম………..
তখন আমরা তরুন/ কিশোররা সহ আবাল বৃদ্ধ- বনিতা সকলে কি করব দিশেহারা। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ( শেখ সাহেব) ৭ই মার্চে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বজ্রকন্ঠে ভাষনে বললেন। আমি/ আমরা রেডিওতে শুনলাম।
তিনি বললেনঃ—
আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি,
যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা কর,
তোমরা প্রস্তুত থেক,
ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল,
এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম,
জয়বাংলা।
শেখ সাহেবের ( বঙ্গবন্ধু ) ভাষণ শুনে আমি সাহসিকতার সহিত উদ্বুদ্ধ হলাম যুদ্ধে যাব।তখন আমাদের এখান হতে কত মানুষ যুদ্ধে যাচ্ছে।নাম লেখাচ্ছে মুক্তিবাহিনীতে।ভারত যাচ্ছে ট্রেনিং করার জন্যে।আমিও যেতে চাইলাম।তোমাদের দাদী আমাকে যেতে দিতে চাইলনা। বললো, “তুমি আমার ছোট ছেলে,অনেক আদর ও সোহাগের…….”
তার পর আমি একদিন রাতের আধাঁরে বাড়ি হতে বের হলাম,এবং জিন্নাত,সামচেল,আবু বক্কারদের সাথে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।ভারত যাওয়ার সময়ে পথে পথে দেখলাম মানুষের লাশ আর লাশ। চারিদিকে হাহাকার আর কান্নার শব্দ। পায়ে হেটে চলেছি। পেটে ভাত নেই। ক্ষুদার যন্ত্রনায় পা চলেনা। গামছার গিটে অল্প কয়টা চিড়া।
আমরা যখন বেনাপোল বর্ডারের কাছাকাছি নাভারন নামক স্হানে এক বিলের মধ্যে, কোমর পানিতে, ওপার যাব।এমন সময়ে ওখানকার স্হানীয় রাজাকারেরা আমাদের ধাওয়া করে।কোনমতে কচুরীপানা মাথার উপর দিয়ে নাকটা ভাসিয়ে চিৎ হয়ে বিলের ওপাড় কুলে এলাম এবং উঠলাম এক বাড়িতে।শুনি এটা এক রাজাকারের বাড়ি। রাজাকারের চারটা বউ। একবউ আমাদের ঘরের ভেতর ঠাঁই দিল।কিছুটা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। একটু রাত হলে আমাদের ভারত যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়। আহারে কত ভাল মানুষ ছিল রাজাকারের বউটা!!!
হাটছি আর হাটছি, এর মধ্যে ঘটে যায় জীবন- মৃত্যুর সন্ধীক্ষনের অনেক ঘটনা। বলতে গেলে রাত পোহাবেনা।
এ রাত বড় কষ্টের………….
আমরা রানাঘাট পার হয়ে ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দিলাম।শুরু হলো ট্রেনিং, বাম…… ডান…… বাম………
এভাবে কয়েকদিন ট্রেনিং করার পর, এবার ফায়ার ট্রেনিং,
হাতে পেলাম থ্রী নট থ্রী রাইফেল।ভেতরটা যেন আগুন জলছে।
দেশে গিয়ে উপড়ে ফেলব রাজাকার, আল শামস, আলবদর, পাকবাহীনির শিকড়।চোখে মুখে আমাদের প্রতিশোধের আগুনের শিখা জলছে অবিরত।
ট্রেনিং করা অবস্হায় কমান্ডার নির্দেশ দিলেন, এবার…. থাম…. বাম… ডান… বাম।
সু- খবর আছে,,
পাকবাহিনী ৯৩ হাজার সৈন্য সহ আত্বসমার্পন করেছে মিত্র বাহিনীর কাছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।এই মাত্র খবর এলো,
খবর শুনে আমার ভেতরে আর আমি নেই।সমস্বরে বলে উঠলাম সবাই…
জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। কতদিন মায়ের মুখটা দেখিনা………..
ফিরে এলাম আমার লাল সবুজের শ্যামল মায়ার বাংলায়। ফেরার পথে ট্রেনিং সনদ খানা ভারত সিমান্ত পার হওয়ার সময় ছিড়ে ফেলে দিলাম।বাংলা এখন স্বাধীন। কি হবে সনদ দিয়ে?
ফিরে এলাম মায়ের কোলে……
গায়ে ফিরে শুনি আমার চাচাত বোনের ছেলে ময়েন পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হয়েছে ।আরো কতজন………
বঙ্গবন্ধু ( শেখ সাহেব) গদিতে বসল। কত সুন্দর করে দেশ পরিচালনা করতে লাগল। যুদ্ধবিদ্ধস্হ, বন্যাকবলিত, খরায়, জরাজির্ন, এই দেশটাকে উন্নয়নের গতিধারায় ফিরিয়ে আনতে লাগল।মাত্র দুই/ তিন বছরে এদেশটাকে বঙ্গবন্ধু নিয়ে গেল এক অনন্যধারায়। শেখ সাহেব ( বঙ্গবন্ধু ) কত কাজ করল,রাস্তা ঘাট,ব্রিজ, কল কারখানা,
কত সাহায্য আনলো বিদেশ হতে।
স্বপ্ন দেখত সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে। তাইতো বঙ্গবন্ধু তার ভাষনে বলেছিলঃ–
আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাইনা….
এইতো আমাদের শেখ সাহেব।
১৯৭৫ সাল। আমি পুব ডাঙ্গার মাঠে তোমার বড় চাচার সাথে ধান কাটতে গিয়েছি। কে যেন রেডিওতে খবর পাঠ শুনে আমাকে দৌড়ে গিয়ে খবর দিল… হাউ মাউ করে কাঁদছে আর বলছে বঙ্গবন্ধু আর নেই ( শেখ সাহেব) । তাকে সহ তার পরিবারের সবাইকে ঘাতকরা ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলেছে।আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিনা।আমি একি শুনছি।আমি নিস্তেজ হয়ে পড়ছি।হাত হতে ধান কাটা কাঁচি খানা পড়ে উরুতে জখম হলো। আমার সারা শরীর রক্তে ভেসে গেল।দুনিয়াটা ঘুরছে।আকাশ যেন চেপে বসেছে আমার মাথার উপর।দিগিগ্বীক জ্ঞানশুন্য হয়ে /অচেতন হয়ে পড়ে গেলাম ধানি জমিতে। সবাই ধরাধরি করে বাড়িতে এনে ঘরের মেঝেতে শুইয়ে দিল।
চেতনা ফিরে পাওয়ার পর দেখি মা আমার শিয়রে বসা। মাকে জড়িয়ে ধরলাম, আর চিৎকার করে হাউ মাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম মায়ের কোলে। বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলাম………..
যার ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে যাবার জন্যে মা তোমাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম। যার জন্যে এদেশ পেলাম, পেলাম স্বাধীন ভূ- খন্ড ও লাল সবুজের মানচিত্র। তাকে ঘাতকরা বাঁচতে দিলনা মা। স্ব- পরিবারে হত্যা করল ওরা বাংলার স্হপতিকে।ওরা ক্ষত বিক্ষত করল একটি লাল সবুজের পতাকাকে……
অঁ- অঁ… হুঁ- হুঁ……. এ কান্না থামার নয় মাগো……
বঙ্গবন্ধু (শেখ সাহেব ) মরে নাই মা। বঙ্গবন্ধুকে আমি এই বাংলার শ্যামল সবুজের নির্মল বাতাশে দেখতে পাই। বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পাই আমি আমার আমিত্বের ভেতরে…..
এভাবেই কান্না জড়িত কন্ঠে বাবা বলে যাচ্ছিলেন সেদিনের সেই দুর্বিসহ দিনগুলোর কথা…….
বাবার সাথে আমি/ আমরা ভাই বোনও চোখের জলে একাকার হয়ে যাই……..
আমরা যেন ফিরে গিয়েছিলাম বাবার স্মৃতিমন্থনের সাথে ১৯৭১ ও ১৯৭৫ এর সেই ভয়াল বিভিষিকাময় দিনে…….
ততক্ষনে মা থালায় থালায় ভাত আর পুঁটি মাছের ঝোল তুলে দিলেন আমাদের সামনে…….
হে বঙ্গবন্ধু, হে বাংলার স্হপতি, হে বাঙ্গালী জাতীর জনক, তুমি আছ বাংলার শ্যামল ছায়ার রুপে। তুমি আছ দোয়েল পাখির শীষে। তুমি আছ রাখালের বাশিঁর সুরে।তুমি আছ ধানের ক্ষেতের আউলা বাতাশে।তুমি আছ মধুমতি নদীর জলের ঢেউভাঙ্গা শব্দে।তুমি আছ সদা জাগ্রত প্রত্যেক বাঙ্গালীর চিন্তা চেতনায়,হৃদয়ে,মননে উজ্জল নক্ষত্র হয়ে এক অবিস্বরনীয় নেতা ও আদর্শ হয়ে।
হে বিশ্বনেতা, হে বাংলার কবি, তুমি এসে দেখে যাও……….
শোককে শক্তিতে রুপান্তর করে আমরা গড়ছি/ গড়ব তোমার স্বপ্নের সোনার বাংলা…………. ।।
© All rights reserved 2000-2025 © kalerchaka.Com
Leave a Reply