করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়গুলোর একটি হিসেবে বিশেষজ্ঞরা যে বিষযটির দিকে সবাইকেই খেয়াল রাখতে বলছেন, তাহলো সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, অর্থাৎ অন্যদের কাছ থেকে শারীরিকভাবে খানিকটা দূরে থাকা। কিন্তু জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে এলে তা কতটা মানা সম্ভব, তা একটি বড় প্রশ্ন হয়েই থাকছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে হলে কিছু অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, নিয়মিত সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া। কারণ সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া হলে তা হাতে থাকা জীবাণুকে মেরে ফেলে। একই কারণে সাবান-পানি না থাকলে অ্যালকোহল সমৃদ্ধ হ্যান্ড রাব বা স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে বলা হয়।
এর পরের ধাপটি হচ্ছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অন্যদের কাছ থেকে কমপক্ষে এক মিটার বা তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
কেন? – কারণ, হাঁচি, কাশি বা কথা বলার সময় মানুষের নাক বা মুখ থেকে যে ড্রপলেটস বের হয়, তাতে ভাইরাস থাকতে পারে, আর আক্রান্ত ব্যক্তির খুব বেশি কাছে গেলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে এই ড্রপলেটস কোভিড-১৯ এর ভাইরাস নিয়ে আপনার মধ্যে ঢুকতে পারে।
সতর্কতা হিসেবে ভিড় এড়িয়ে চলারও পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কারণ সংস্থাটির মতে, ভিড়ের মধ্যে গেলে কোভিড-১৯ আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে এবং অন্যদের থেকে এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখাটাও সম্ভব হয় না।
শুধু তাই নয়, সংস্থাটি বলছে আমাদের আশেপাশে যেসব মানুষ থাকে তারাও যাতে ভালভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের আদব মেনে চলেন তাও নিশ্চিত করতে হবে।
তার মানে হচ্ছে, হাঁচি বা কাশি দেয়ার সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখতে হবে – না হলে কনুই বাঁকিয়ে তার মধ্যে হাঁচি-কাশি দিতে হবে। পারলে হাঁচি ও কাশি দেয়ার সময় টিস্যু ব্যবহার করতে হবে, যাতে এর মাধ্যমে ড্রপলেটস অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে না পরে। পরে টিস্যুটি ফেলে দিয়ে সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে।
হাঁচি-কাশির আদব মেনে চললে আশেপাশের মানুষকে ফ্লু বা কোভিড-১৯ এর মতো সংক্রমণ থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব।
কিন্তু বাংলাদেশে লকডাউন শিথিল এবং মার্কেটসহ নানা ধরণের প্রতিষ্ঠান চালু করার ঘোষণা দেয়ার কারণে এই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাটাই একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কারণ বাস্তবতা হলো, মার্কেটে গিয়ে বা ভিড় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন জায়গায় গিয়ে, আসলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখা আদৌ সম্ভব নয়।
এছাড়া বাংলাদেশে বেশীরভাগ এলাকাই ঘন বসতিপূর্ণ হওয়ায় লকডাউন ছাড়া সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করাটাও প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
এমন অবস্থায়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিজেকে কীভাবে রক্ষা করা সম্ভব?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণের ধারা যেহেতু উর্ধ্বমুখী, তাই লকডাউন শিথিল করাটা খুবই বিপদজনক হয়েছে। বাংলাদেশ বিপদে পড়তে যাচ্ছে কি-না, তাও সাত থেকে ১৪ দিনের মধ্যে বুঝা যাবে বলে মনে করছেন তারা।
উপায় কী?
এমন মুহূর্তে যাদের বাইরে বের না হলে কোন ধরণের অসুবিধা নেই, এমন মানুষদের ঘরেই থাকা উচিত বলে মত দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আর বের হতে হলেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোন বিকল্প নেই বলেও মত তাদের।
আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাইরে বের হতে হলে অবশ্যই মাস্ক পড়তে হবে, সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
আর এ বিষয়ে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রমণ রোগ ও রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের পরিচালক শাহনীলা ফেরদৌস বলেন, দরকার না হলে বাইরে না যাওয়াটাই হবে সবচেয়ে বড় সতর্কতামূলক পদক্ষেপ।
তবে যদি বাইরে যেতেই হয়, তাহলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি। এই বিশেষজ্ঞের মতে, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এর কোন বিকল্প নেই।
তবে বাংলাদেশে জনঘনত্ব বেশি বলে অনেক ক্ষেত্রেই এটা মেনে চলা কঠিন বলেই মনে করেন শাহনীলা ফেরদৌস।
“আমি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছি কিন্তু অন্য কেউ হয়তো চলে, আসলো তাকে তো আর সরিয়ে দিতে পারবো না,” তার মন্তব্য।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব না হলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে কিছু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এগুলো হচ্ছে –
১. মাস্ক যথাযথভাবে পরা
ভিড় বা জনসমাগমে যেতে হলে প্রথমেই যে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে, আবশ্যিকভাবে মাস্ক পরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাস্ক পরার কোন বিকল্প নেই।
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, কোভিড-১৯ রোগীর সংস্পর্শে যেতে হয় এমন চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে যদি এন-৯৫ মাস্ক না থাকে, তাহলে তারা সার্জিক্যাল মাস্ক এক সাথে দু’টি পড়তে পারেন। এমনকি তিনটিও পরা যেতে পারে।
দু’টি বা তিনটি সার্জিক্যাল মাস্ক একটি এন-৯৫ মাস্কের বিকল্প। তবে এন-৯৫ মাস্ক থাকলে একটি পরলেই হবে।
অচেনা মানুষের সামনে বা বাইরে গেলে এক সাথে দুটো মাস্ক পরার প্রয়োজন নেই।
তবে যে মাস্কটি পরা হচ্ছে, সেটি সঠিক নিয়মে পরতে হবে। নাক-মুখ পুরোপুরি ঢেকে দিতে হবে। নাকের সাথে মাস্কের মাঝখানে যাতে কোন শূন্যস্থান না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
মাস্কের ভেতরে যাতে বাতাস প্রবেশ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। নাক বা থুতনি বাইরে বেরিয়ে থাকলে দুটি মাস্ক পরেও কোন লাভ হবে না।
শাহনীলা ফেরদৌস বলেন, প্রয়োজন হলে ঘরে তৈরি করা তিন স্তর বিশিষ্ট কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে, এ ধরণের মাস্ক এক বার ব্যবহারের পর সেটি সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে বারবার ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
২. গন্তব্যে যাওয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যতবার সম্ভব হাত ধোয়া
বাইরে বের হলে যতটা সম্ভব সাবধান থাকতে হবে, যাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয়। সেটি না হলে বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকে শুরু করে গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত যতবার সম্ভব সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এখন বিভিন্ন অফিস, দোকান, ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানের বাইরে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকে। এগুলো ব্যবহার করে বারবার সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়ার চেষ্টা করতে হবে।
এছাড়া হাত না ধুয়ে কোনভাবেই চোখ, মুখ ও নাকে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৩. সাবান দিয়ে গোসল করা
শুধু কাপড় পরিষ্কার করা বা হাত-মুখ ধুলেই হবে না।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে হলে, বাইরে থেকে আসার পর পুরো শরীরে সাবান মেখে গোসল করে নিতে হবে। এর আগে পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে যাওয়া যাবে না।
পরিবারে বয়স্ক বা শারীরিকভাবে অসুস্থ বা ঝুঁকিপূর্ণ কেউ থাকলে তাদের কাছ থেকে এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
৪. পরিহিত পোশাকটি ধুয়ে ফেলা
বাইরে বের হওয়ার পর বাসায় ফিরলে পরিহিত পোশাকটি সাবান এবং পানি দিয়ে কমপক্ষে আধাঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। তার পর এটি ধুয়ে ফেলতে হবে।
এমনকি পরিহিত জুতা জোড়াও ঘরের বাইরে রাখতে হবে এবং সেগুলো সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
৫. চশমা-গ্লাভস-পিপিই’র ব্যবহার
শাহনীলা ফেরদৌস বলেন, যেহেতু চোখের মধ্য দিয়েও করোনাভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে, তাই এটি ঠেকাতে সতর্কতার অংশ হিসেবে জিরো পাওয়ারের গ্লাস বা চশমা পরা যেতে পারে। এতে করে চোখ সরাসরি ড্রপলেটস থেকে দূরে থাকবে বলে জানান তিনি।
তবে মুশতাক হোসেন বলছেন, বাইরে বের হওয়ার সময় হাতে গ্লাভস বা পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক) পরাটা জরুরী নয়। কারণ গ্লাভস পরলে সেটা যদি পরিবর্তন করে আরেকটি পরা না যায়, তাহলে সেটি কোন কাজে আসে না।
এর চেয়ে সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়াটা অনেক বেশি নিরাপদ বলে মত দেন মুশতাক হোসেন। একই কথা তিনি বলেছেন পিপিই বা ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক পরার ক্ষেত্রেও।
তার মতে, যাদেরকে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি পরিবহন, মরদেহ সৎকার কিংবা চিকিৎসা দেয়ার মতো কাজ করতে হয় না, তাদের পিপিই বা ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক পরার দরকার নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে হলে – বিশেষ করে যখন বাংলাদেশে সংক্রমণের হার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে তখন – ব্যক্তিগত সচেতনতাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
© All rights reserved 2000-2023 © kalerchaka.Com
Leave a Reply