পারভেজ মোশারফ :
অদ্বিতীয়া তোমাকে
লিপি মারা গেছে আজ চারদিন। বাসায় কিছু কাছের আত্মীয় ছাড়া, তেমন কোন কোলাহল নেই। চুপচাপ হয়ে আছে পুরো বাড়িটা। মনে হচ্ছে যেন নিঝুম রাত্রিবেলা, আর তাই সবাই রাতকে আশ্রয় করে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আজকাল অবশ্য ভদ্রলোকদের মৃত্যুতে মানুষ খুব একটা কান্নাকাটি করে পুরো বাড়িকে মাথায় তুলে মাতম করে না। শোক পালনও আজকাল হিসেবের খাতায় ঢুকে গেছে, আবার কখনো মনে হয় বেশি শোক পালনে বুঝি ট্যাক্স বেশি আসার ভয়ে মানুষ হিসেব করে তা পালন করে !
আহা মানুষের জীবন! যতক্ষণ দম আছে ততক্ষণই তার দাম, দম ফুরোতেই ট্যাক্স বাড়ার চিন্তায় সব কিছু নমো নমো করে সাড়ার ধান্দা শুরু হয়ে যায় ! মানুষ যেন সব এক একটা নিয়মে বাধা ব্যাটারি চালিত কোন পুতুল কিংবা রোবট। দিনে দিনে সব কেমন অনুভূতিশূন্য হয়ে যাচ্ছে! একান্ত কাছের লোকজনরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কষ্ট পায় তবুও তার প্রকাশ থাকে বড্ড বেশি কম। এটা আবার কখনো শব্দ করে আহাজারির চাইতেও বেশি কষ্টের। শব্দ করে কাঁদলে তবু ভেতর হালকা হয়। কিন্তু গুমরে গুমরে কাঁদলে পরিবেশ গুমোট হয়,কিন্তু ভেতরটা আস্তে আস্তে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় অনেকটা সময় ধরে।
এই বাড়িতে তিনটা ভাড়াটে থাকে , এটা একটা সাড়ে তিনতলা বাড়ি। তবুও সবাই বুঝি আজ লিপির জন্য শোকে মেতেছে,নিস্তব্ধ হয়ে আছে তাদের সমস্ত ভূতল । লিপির সাথে ভাড়াটেদের খুব আত্মিক সখ্যতা ছিল। বাইরে থেকে কেউ না জানলে হয়ত ভেবেই নিবে যে, এটা একটা জয়েন্ট ফ্যামিলি।সবার সুখে দুঃখে সর্বদা পাশে এসে দাঁড়াতেন তিনি। তাই এই নিস্তব্ধতা শুধু লিপিকে ভালোবেসে। সবাই অন্তরআত্মা দিয়ে শোক পালন করছে। অন্যদের জন্য যা লোক দেখানো কিংবা স্বার্থের দন্দ্ব, লিপির বেলায় মোটেও তা না, কারণ তিনি ছিলেন অনন্য চরিত্রের অধিকারী। আমরা যদি মহীয়সী নারী বলি তাকে তবু কিছু ভুল বলা হবে না।
অদ্বিতীয়া এসেছে মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনেই। তবুও তার যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসতে আসতে দুইদিন লেগে গেছে । এই দুইদিন লিপি হিমঘরেই ছিল, গতকাল তাকে দাফন করা হয়েছে।
অদ্বিতীয়া মায়ের স্টাডি রুমে এসেছে অনেক্ষণ আগে । এসে আলমারিটা খুলে দাঁড়িয়ে রইলো অনেকটা সময় নিয়ে । সে জানতো ছোটবেলা থেকেই তার মা ডায়েরি লিখে। একদিন দিনপঞ্জিকায় কিছু না লিখে তার মা ঘুমাতে যেতেন না। অদ্বিতীয়া যখন বড় হচ্ছিল তখন লিপি তাকে বলতো,”আমি বেঁচে থাকতে কখনো এগুলো খুলবে না। যখন আমি থাকব না তখন তুমি এগুলো খুলবে,আর এর মধ্যেই আমাকে খুঁজে পাবে। আমার সব বলা না বলা কথাগুলো এরমধ্যেই লিপিবদ্ধ থাকবে ।” অদ্বিতীয়া তা মেনে চলেছে, কোনদিন মা’য়ের এই গোপনীয়তাকে ভাঙতে চায়নি। কিংবা সে-ই আগ্রহ কোনদিন তৈরিই হয়নি।
অদ্বিতীয়া কাঁপাকাঁপা হাতে মায়ের সাদা, কালো, লাল,হলুদ মলাটের চারটা মোটা মোটা ডায়েরি হাতে নিল। ডায়েরিগুলোর মলাট দেখে হঠাৎ মনে হবে এগুলো বোধহয় কোন দামী গয়নার বাক্স। এমন সুন্দরভাবেই মলাট দিয়ে সেগুলোকে বাঁধানো। ডায়েরিগুলো হাতে নিয়ে বসে রইলো আরও কতক্ষণ!……বুঝতে পারছে না কীভাবে খুলবে, কী লিখা আছে মা’র দিনপঞ্জিতে। ছাদের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে বসলো।
সে এখন লিপির সবচেয়ে প্রিয় জায়গাটায় গুঁটি গুঁটি পায়ে চলে এসেছে। এই সাজানো অংশটা অদ্বিতীয়া আগে কখনো দেখেনি। সে চলে যাওয়ার পর লিপি এটুকুকে বাড়িয়ে নিয়েছিল স্টাডির জন্যই। তার সারাজীবনের এই একটি ইচ্ছেই ছিল এমন একটা লাইব্রেরীর, একটা স্টাডি রুমের! সে অবশ্য শেষ অব্দি তা করে উঠতে পেরেছিল।
এটা একটা বিশাল বড় ঘর,লাগোয়া বাথরুম আর টানা বারান্দা নিয়ে। সামনে খোলা ছাদ। আর তাতে হাজারো রকমের রঙিন ফুলের গাছ, যেন আস্ত একটা বনানী । এখনো গাছগুলো কেমন যেন মনে হচ্ছে হাসছে, কথা কইছে। কিন্তু তারা জানে না তাদের মালি জীবন থেকে পালিয়েছে। আর কোনোদিন নিজ হাতে তাদের সেবা শুশ্রূষা করতে আসবে না।
ঘরটা জুড়ে আছে শুধু বিশাল বিশাল বই এর তাক। তিনটা দেয়াল জুড়েই টানা ওয়াল সুকেস ভর্তি শুধু বই আর বই। কতো কতো রকমের যে বই! কি নেই এখানে…. মা’র প্রিয় সমরেশ মজুমদারের বইগুলো যেন মা’র আঙুলের স্পর্শ পেতেই চেয়ে আছে তার পানে । অদ্বিতীয়া ভাবছে সে কেন কখনো মা’র মতো হতে পারলো না! মা’র ব্যক্তিত্ব যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে যেতো। এই ঘরটাই তো তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ। সারাটা ঘর থেকেই যেন একটা হিমশীতল আবহাওয়া বয়ে যাচ্ছে, মা’র ইজি চেয়ারটা কী চমৎকার ডিজাইনের… সেগুন কাঠের ছিমছাম কিন্তু অসাধারণ কারুকাজের! এর পাশে পড়ার টেবিলটায় এখনো মার শেষ পড়া বইটার পাতা উল্টিয়ে রাখা আছে, সুচিত্রা ভট্টাচার্যের “কাছের মানুষ”। মা তো এই বইটা সেই আমার ছোট বেলাতেও পড়েছিল। আবারও নিয়েছিল বোধহয়। মা একটা ভালো বই পড়ার পর অনেক সময় ঘোরের মধ্যে কাটাতেন। তখন মা’কে চেনা যেতো না। অদ্বিতীয়ার চোখে মায়ের সেই তৃপ্ত মুখখানা জ্বলজ্বল করে ভাসছে।
একটা সিঙ্গেল খাটও রাখা আছে একপাশে।বোধহয় পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে এখানেই ঘুমিয়ে পরতেন। ভারী পর্দায় এই দুপুর বেলাটা কেও কেমন সন্ধ্যা মনে হচ্ছে। অদ্বিতীয়া ডায়েরি গুলো নাড়াচাড়া করছে, প্রত্যেকটা ডায়েরির উপরে আলাদা আলাদা নাম লিখা আছে । সাদা রঙেরটায় লিখা “আমার জীবনের প্রাপ্তি,অপ্রাপ্তি “, কালোটাতে লিখা “আমার যত ভুলগুলো ” হলুদটার আবার নাম রেখেছে “, তুমি -আমি”
সবশেষটায় লিখা ” অদ্বিতীয়া তোমাকে “, অদ্বিতীয়া যেন চমকে গেলো এটা দেখে। একটা হাজার পাওয়ার ভোল্টের শক খেয়ে মানুষ যেমন কিছুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় ঠিক তেমন!মা শুধু তার জন্য একটা আস্ত ডায়েরি লিখেছিল ? তা-ও আবার এতো সুন্দর লাল মলাটের ডায়েরিটাই! মা’র তো প্রিয় রং ছিল এই লালই। পছন্দের রংটাও তাকেই দিয়ে গেলো?
খুব আস্তে আস্তে ডায়েরিটার পাতা উল্টাচ্ছে আর দেখছে প্রতিটা পাতা ভর্তি করে লিখা। একদম শেষের পাতাটা পর্যন্ত একটুও খালি নেই! তবে মা কী তার আয়ু সম্পর্কে সব জানতেন? কী অভিমানী ছিল মা আমার, একটাবার জানতে দেননি, বুঝতে দেননি নিজের ভিতর কী রোগের বাসা বেধেছিল!
অদ্বিতীয়া কয়েকটা পাতা উল্টাতেই এক জায়গায় দেখতে পেলো লিখা আছে তাতে, “তুমি এখন “দিতি” হয়ে গেছো।কেউ তোমাকে আর অদ্বিতীয়া নামে ডাকে না,ডাকবে কীভাবে? তুমি তো তোমার না
© All rights reserved 2000-2023 © kalerchaka.Com
Leave a Reply