প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাসের মধ্যেও উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। গত রোববার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের কার্যনির্বাহী কমিটির (একনেক) নিয়মিত সভার প্রারম্ভিক বক্তব্যে তিনি বলেছেন: করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। তারপরও আমরা অন্তত চেষ্টা করে যাচ্ছি যে, ধারাবাহিকতাটা বজায় রেখে উন্নয়নের মূল গতিটা ধরে রাখার। যে কারণে আমরা প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। বলা বাহুল্য, করোনাকারণে দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন কার্যক্রম বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। কয়েক মাস লকডাউনের নামে গোটা বিশ্ব কার্যত অচল ছিল। এতে ভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে কিছুটা ভালো ফল পাওয়া গেলেও ভাইরাসটিকে নির্মূল বা বিদায় করে দেয়া সম্ভব হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর প্রতিষেধক আবিষ্কার ও প্রয়োগ না হওয়া পর্যন্ত আশঙ্কার মধ্যেই থাকতে হবে। এ অবস্থা কতদিন প্রলম্বিত হবে, কেউ বলতে পারে না। কিন্তু ততদিন অর্থনৈতিক তৎপরতা, উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন, চলাচল ও যাতায়াত বন্ধ থাকতে পারে না। এই বিবেচনায় প্রাধান্য দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ লকডাউন প্রত্যাহার করে আর্থবাণিজ্যিক কার্যক্রম ও উন্নয়নকর্মসহ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ ও কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। লকডাউনের সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এখন অর্থনীতির ক্ষতি কাটিয়ে উঠে তাকে গতিশীল করা এবং অসমাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্প বা কাজ সমাপ্ত করার সময় উপস্থিত। এছাড়া বিকল্প নেই। লকডাউন ও প্রায় অচলাবস্থা অব্যাহত রাখার অর্থ, সব কিছু এমন একটা প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেলে দেয়া, যা থেকে উঠে আসা অসম্ভব পর্যায়ে চলে যেতে পারে। দেশে দেশে যখন সব কিছু খুলে দেয়া হচ্ছে, উন্মুক্ত করে দেয়া হচ্ছে, তখন বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম অনুসরণ করতে পারে না। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুধাবন করেই অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টা নিয়েছেন। তার এই প্রচেষ্টার আবশ্যকতা প্রশ্নাতীত।
পরিস্থিতি অনুধাবনে সাধারণ মানুষ ও পেশাজীবীদের দৃষ্টিকোণ আর প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিকোণ এক বরাবর হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর সামনে দেশ ও সব শ্রেণির মানুষের স্বার্থ ও কল্যাণই বড়। অনেকেই মনে করতে পারে, লকডাউন তুলে নেয়া ঠিক হয়নি। এতে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ারও এটা কারণ হতে পারে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন সব কিছু অচল রাখা যায়? বিভিন্ন ক্ষেত্রে করোনার প্রতিক্রিয়া দিন কে দিন বাড়ছে। উৎপাদন, রফতানি, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্রমাগত কমছে। এ অবস্থা চলতে পারে না। কাজেই, করোনার ঝুঁকি সত্তে¡ও আমাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম জোরদার করতে হবে এবং উন্নয়নের ধারাবাহিকতা এগিয়ে নিতে হবে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর উপলব্ধি যথার্থ এবং তার উদ্যোগ-পদক্ষেপ বাস্তবোচিত। একনেকের ওই সভায় গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে সংসদ সদস্যদের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৬ হাজার ৪৭৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। ‘গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-৩’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় তারা এই বরাদ্দ থেকে প্রত্যেকে ২০ কোটি টাকা করে পাবেন। এছাড়া আরো ৯টি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। সব মিলে ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী ওই সভায় কিছু দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন, যা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এগুলো হলো: মাছ চাষের জন্য জলাশয়ের পাড় সংস্কার করলেই হবে না, পানির উপর-নিচের আবর্জনাও পরিষ্কার করতে হবে, জলাশয়ের গভীরতা সঠিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে। দেশে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে তুলতে হবে, বালুমহালের স্থান চিহ্নিত করে সময়ে সময়ে পরিবর্তন করতে হবে, এতে নদী ভাঙন কমবে, স্থানীয় সরকারের রাস্তাগুলো যথাযথ মান বজায় রেখে নির্মাণ করতে হবে, প্রত্যেক কারাগারে ভার্চুয়াল কোর্টের ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং রেলওয়ে কারখানাগুলোর আধুনিকায়ন করতে হবে। নির্দেশনাগুলো বর্তমান প্রেক্ষিতে এতটাই গুরুত্ববহ যে, এদের দ্রুত বাস্তবায়ন আমরা আশা করি।
গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে সংসদ সদস্যেদের প্রত্যেকের অনুকূলে ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা নিয়ে অনেকে শঙ্কিত। তারা মনে করেন, এই অর্থের বড় অংশ লোপাট বা বেহাত হয়ে যেতে পারে। অতীতে এমন নজিরের অভাব নেই। সংসদ সদস্যদের দুর্নীতি ও নানা অপকর্মের জন্য সরকারি দল ও সরকারকে অনেক সময়ই বেকায়দায় পড়তে হয়। সম্প্রতি সংসদ সদস্য শহীদ ইসলাম, এনামুল হক ও নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বিরুদ্ধে অর্থপাচারসহ নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে। আগেও কোনো কোনো সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে মানবপাচার ও মাদক কারবারের অভিযোগ উঠেছে। সরকারের তরফে বরাদ্দকৃত অর্থের নয়-ছয় করার অভিযোগ তো বলতে গেলে সাধারণ অভিযোগ। তবে এমন সংসদ সদস্যের সংখ্যাও নিতান্ত কম হবে না, যারা সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থের পাই টু পাই ব্যয় করেছেন এলাকার উন্নয়নে। ওইসব সংসদ সদস্যের এলাকায় রাস্তা-ঘাটসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ও মানবিক উন্নয়ন যথেষ্টই হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রত্যেক সংসদ সদস্যর জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের সমুদয় যাতে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয়িত হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। নজরদারি, তত্ত্বাবধান ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। করোনাকারণে স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন অগ্রাধিকার দিতে হবে। স্বাস্থ্যখাতের অনেক উন্নতির কথা বলা হয়েছে। করোনাকালে দেখা যাচ্ছে উপজেলা-জেলা পর্যায়ের অনেক হাসপাতালেই আইসিইউ পর্যন্ত নেই। প্রতিষ্ঠান আছে; ডাক্তার নেই, যন্ত্রপাতি নেই। স্বাস্থ্যখাতে অবকাঠামোগত দুর্বলতা কতটা, এটা প্রত্যক্ষ করা গেছে এবার। অথচ এই খাতের দুর্নীতি আকাশ ছুঁয়েছে। দুর্নীতি ঠেকাতে হবে এবং চিকিৎসা সুবিধা বাড়াতে হবে। এর অন্যথা কাম্য নয়। সবচেয়ে বড় কথা সব খাতের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দিতে হবে। দুর্নীতি করলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
Daily Inqilab (aditya.fouzder@link3.net) , 2020-06-23 06:03:55
© All rights reserved 2000-2025 © kalerchaka.Com
Leave a Reply