বিশ্বের দ্বিতীয় পরাশক্তি দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতার একমাত্র সন্তান তিনি। কিন্তু ইভাঙ্কা ট্রাম্প বা সাশা ওবামার মতো প্রচারের আলোয় থাকতে চান না তিনি। এমনকি খুব বেশি মানুষ জানেই না শি জিনপিংয়ের একমাত্র মেয়ের নাম শি মিংজে।
শি জিনপিং ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী চীনের বিখ্যাত লোক সংগীত শিল্পী পেং লিউয়ানের একমাত্র সন্তানের মৌলিক কিছু তথ্য ছাড়া বিশ্বের কাছে বেশিরভাগই অজানা। ২৭ বছরের মিংজের জন্ম ১৯৯২ সালের ২৭ জুন। হাংজু ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজেস স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নের সময় শিখেছেন ফরাসি ভাষা।
২০১০ সালে তাওয়ানের চায়না টাইমস-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, দাদা কমিউনিস্ট বিপ্লবী ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা শি জংজুন তার ডাক নাম রেখেছিলেন শিয়াও মুজি। সংবাদমাধ্যমটি তাকে সরল ও মার্জিত ব্যক্তি, যিনি সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নির্ঝঞ্ঝাট হিসেবে মেংজি পরিচিত। শখের মধ্যে রয়েছে বই পড়া ও ফ্যাশন।
২০০৮ সালে সিচুয়ানে ভয়ংকর ভূমিকম্পের পর ওই সময় ১৬ বছরের মেংজি স্কুলে এক সপ্তাহের ছুটির আবেদন করেছিলেন। এই ছুটিতে তিনি দুর্যোগে ত্রাণ কার্যক্রম ও আহতদের সেবায় নিয়োজিত হতে চেয়েছিলেন। ওই সময় তার মা স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছিলেন।
ওই সময় মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন কিনা জানতে চাইলে পেং বলেন, ‘ভূমিকম্পের ফলে অনেক প্রাণহানি হয়েছে এবং বড় ধরনের দুর্যোগ দেখা দিয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে আমার মেয়ের ফ্রন্টলাইনে থেকে সহযোগিতা করা উচিত। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সাত দিন সে কঠোর পরিশ্রম করেছে এবং কখনও অভিযোগ করেনি। সে অনেক কিছু শিখতে পেরেছে এবং স্থানীয় অনেকের সঙ্গেই তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। সে বলেছে, সিচুয়ানের মানুষ খুব ভালো, দৃঢ় ও দয়ালু।’
দিনের ২৪ ঘণ্টা চীনা দেহরক্ষীরা মিংজের সঙ্গে থাকেন বলে বলা হয়ে থাকে। মেয়ের জীবনে গোপনীয়তা রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট চীনা প্রেসিডেন্ট। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইও তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গোপনে এজেন্ট নিয়োগ দিয়েছিল বলে তাইওয়ানি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের গোপন মেয়ের মতোই চীনা নেতা মিংজেকে বাইরের বিশ্ব নিয়ে আগ্রহী হওয়া থেকে জোর করে ঠেকিয়ে রাখেন। এক্ষেত্রে কমিউনিস্ট স্বৈরশাসকদের ইন্টারনেট সেন্সরশিপ ক্ষমতা ব্যবহার করেন তিনি।
২০১০ সালে ছদ্মবেশে ম্যাসাচুসেটসের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করতে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান মিংজে। কিন্তু ২০১২ সালের আগ পর্যন্ত খুব কম লোকই বিষয়টি জানতো। ওই বছরের মে মাসে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট প্রথম জানায় যে, জিনপিংয়ের মেয়ে খ্যাতিমান আইভি লিগ স্কুলের একজন আন্ডারগ্র্যাজুয়েট। তবে প্রতিবেদনে তার সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানানো হয়নি। এতে বলা হয়েছিল, তার উপস্থিতি নির্ঝঞ্ঝাট এবং সহপাঠীরা তাকে পড়ুয়া ও বুদ্ধিমান হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় সংকুচিত হচ্ছে চীনে কমিউনিস্ট শাসন’ শিরোনামের একটি আলোচনায় উপস্থিত হয়েছিলেন মিংজে। যেখানে আলোচনার ফলাফলে প্রত্যক্ষ স্বার্থ থাকা নারী আন্ডারগ্র্যাজুয়েট বসেছিলেন লেকচার হলের একেবারে সামনের সারিতে এবং মনোযোগ সহকারে শুনছিলেন।
২০১২ সালের পরের দিকে যুক্তরাজ্যের মেইল অন সানডে’র এক সাংবাদিক মিংজের পরিচিত কয়েকজনকে শনাক্ত করার দাবি করেন এবং ফেসবুক থেকে নেওয়া তার ছবি সহকারে একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তার এক সহপাঠী ও চীনা লেখক পত্রিকাটিকে বলেছিলেন, মিংজে বই পোকা, খুব শান্ত ও পড়ুয়া। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মিংজে পড়াশোনায় নিজেকে নিবেদিত রেখেছেন। চীনা রাজনীতিক বো শিলাইয়ের ছেলে ও হার্ভার্ডের আরেক উল্লেখযোগ্য চীনা শিক্ষার্থী বো গাউগুয়ার পার্টি লাইফস্টাইল এড়িয়ে চলেন তিনি।
মেইল অন সানডে’র প্রতিবেদনে মিংজে সম্পর্কে খুব বেশি মুখরোচক তথ্য ছিল না। তবুও তা চীনের সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে বিস্ফোরকের মতোই ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবেদনটির একটি ছবি দেশটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ওয়েইবোতে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় লেখা না হওয়াতে ছবিটি সেন্সর এড়াতে পেরেছিল।
ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের নজরদারি সেবা ওয়েইবোস্কোপ জানায়, ছবিটি বারবার প্রকাশিত হতে থাকায় তা নিষিদ্ধ করা হয়। তবে তখন প্রশ্ন ওঠে শি জিনপিংয়ের সরকারি বেতন ১৩ হাজার ডলারের মতো। তারপরও কীভাবে তিনি মেয়েকে বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করাতে কয়েক লাখ ডলার ব্যয় করছেন।
মিংজে মনোবিজ্ঞান ও ইংরেজি অধ্যয়ন করেন এবং ২০১৪ সালে ব্যাচেলর অব আর্টস গ্র্যাজুয়েট হন। পরে বেইজিং ফিরে আসেন।
হার্ভার্ডের অধ্যয়নের সময় মিংজের প্রকৃত পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিলিয়ে দশ জনের কম লোক জানতেন বলে জানিয়েছেন কেনজি মিনেমুরা। আশাহি শিম্বুন সংবাদমাধ্যমের এক প্রতিনিধি মিংজের সমাবর্তনে উপস্থিত ছিলেন।
ফার্স্ট পোস্ট জানিয়েছে, ২০১৩ সালে শি জিনপিং ক্ষমতা গ্রহণের ২০১৫ সালে তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রথম প্রকাশ্যে আসেন। ওই সময় চীনা নববর্ষে শানশি প্রদেশের লিয়াংজিহায়েতে ইয়ানানের একটি গ্রামে স্থানীয়দের তারা শুভেচ্ছা জানান। এই ইয়ানানেই ৭০ দশকে ছয় বছর কাটানো শি জিনপিংয়ের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়।
এরপর থেকেই নিজের জীবন প্রায় নীরবেই কাটাচ্ছেন মিংজে। চীনের কমিউনিস্টি বিপ্লবী নেতাদের বংশধরদের তথাকথিত ‘লাল অভিজাতদের’ তরুণ প্রজন্ম হিসেবে এটি এখনও অস্পষ্ট যে তিনি কোনও দিন প্রকাশ্য জীবনে হাজির হবেন কিনা।
তবে ইতোমধ্যেই মিংজেকে তার বাবার উত্তরসূরি বলা হচ্ছে। পারিবারিক ধারা মেনে তিনিও রাজনীতিতে পা রাখবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু বেশ কিছু মার্কিন ও তাইওয়ানের সংবাদমাধ্যমে আবার উল্টো কথাও উঠে আসছে।
সূত্র: নিউজ ডট কম অ্যাইউ
Leave a Reply