ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি- ভিএআর। প্রযুক্তিটির বিশ্বজোড়া সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ‘ভার’। ফুটবলের পৃথিবীতে এটির আগমন মাঠের কোনও বিতর্কিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে রেফারিদের সাহায্য করতে।
যে বিষয়টির সৃষ্টির সঙ্গে ‘বিতর্ক’ শব্দটি আছে, সেটি নিয়ে তাই বিতর্ক হবেই। কাল রবিবার স্পেনের লা লিগায় রিয়াল মাদ্রিদ বনাম রিয়াল সোসিয়েদাদ ম্যাচটিতে যেমন হলো এবং হচ্ছে। ২-১ গোলে ম্যাচটি জিতে পয়েন্টে শীর্ষে থাকা বার্সেলোনাকে ছুঁয়ে ফেলেছে রিয়াল মাদ্রিদ এবং হেড-টু-হেড সুবিধা নিয়ে শীর্ষেই উঠে গেছে। ম্যাচের তিনটি গোলের সিদ্ধান্ত এসেছে ‘ভার’ থেকে। দুটি সিদ্ধান্ত অনুকুলে যাওয়ায় রিয়াল মাদ্রিদ গোল পেয়ে গেছে, সে দুটি গোলই ভাগ্য গড়ে দিয়েছে ম্যাচের। রিয়াল সোসিয়েদাদের একটি গোল বাতিল হয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে, ‘ভার’ সিদ্ধান্তে পাওয়া পেনাল্টি থেকে সের্হিয়ো রামোস প্রথমে যে গোলটি করেছেন সেটি ঠিক ছিল কি না। আবার একইভাবে করিম বেনজেমার জয়সূচক গোলটিও ‘বিশুদ্ধ’ ছিল কি না, যেহেতু বলটি নিয়ন্ত্রণের আগে তার হাতের ওপর দিকে লেগেছিল। ‘ভার’ বলেছে বল লেগেছিল কাঁধে। কিন্তু বিতর্ক চলছে এই নিয়ে যে ওটা ছিল হ্যান্ডবল। আবার ৬৮ মিনিটে সোসিয়েদাদের ইয়ানুজাইয়ের দেওয়া গোলটি ‘অফসাইড’ বলে বাতিল করেছে ‘ভার’। বলা হয়েছে ইয়ানুজাই যখন গোল করেন, তখন সোসিয়েদাদের একমাত্র গোলটি করা মিকেল মেরিনো ছিলেন অফসাইডে এবং গোলকিপারের দৃষ্টি তিনি আড়াল করে রেখেছিলেন। পাল্টা যুক্তিটি এমন যে, ইয়ানুজাই সরাসরি নিচে থেকে বল পেয়ে এক টাচে গোল করেছেন এবং সেটি অফসাইডের দোষে বাতিল হতে পারে না।
‘ভারের সিদ্ধান্তে’ রিয়াল সোসিয়েদাদের মুখভার। তবে তাদের চেয়েও অখুশি বার্সেলোনা। কারণ সিদ্ধান্তগুলো অন্যরকম হলে রিয়াল মাদ্রিদ জিততে পারে না এবং বার্সেলোনাও শীর্ষস্থান থেকে ছিটকে পড়ে না। স্পেনের ফুটবল এমনিতেই রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা নামের দুটি শিবিরে বিভক্ত। সারাবিশ্বের কোটি কোটি ফুটবলভক্তও সেই সুবাদে দুই মেরুতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন তপ্ত লাভাস্রোত বইছে।
আগের ম্যাচেও ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে ‘ভারের’ আনুকুল্য পেয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। ভ্যালেন্সিয়ার একটি গোল বাতিল হয়েছে ভার-সিদ্ধান্তে। ভ্যালেন্সিয়া ওই গোলটি পেলে এগিয়ে যেত এবং খেলার গতিপ্রকৃতি অন্যরকম হলেও হতে পারতো।
ওই ম্যাচের পর পরই বার্সেলোনা ডিফেন্ডার জেরার্ড পিকে, সবসময়ই যিনি উচ্চকণ্ঠ, বলে বসেন, রিয়াল মাদ্রিদ এরকমই- তারা সবসময়ই রেফারির আনকুল্য পায়। খুবই শান্ত স্বভাবের রিয়াল মাদ্রিদ কোচ জিনেদিন জিদান (২০০৬ বিশ্বকাপের কথা ভুলে যান) আর চুপ থাকতে পারেননি। দূর থেকেই জবাব দিয়েছেন, ‘আমাদের রেফারির আনুকুল্য লাগে না। যা করার আমরা মাঠেই করতে পারি। আমি খুব ভাগ্যবান যে আমি যা চাই সেটি করতে পারি, অন্যরা কী বললো তাতে আমি প্রভাবিত হই না।’
রবিবার সোসিয়েদাদের মাঠ থেকে জয় নিয়ে ফেরার পর ‘ভার’ নিয়ে আর কোনও কথা বলেনি রিয়াল মাদ্রিদ। দরকারই বা কী? তারা জয়ের আনন্দে মগ্ন এবং লা লিগা শিরোপা পুনরুদ্ধারের স্বপ্নে বিভোর, যদিও এখনও অনেক কিছুই ঘটতে পারে, বাকি আছে আরও আট ম্যাচ।
তবে ‘ভার’ নিয়ে বার্সেলোনা শিবিরের অসন্তোষ যাচ্ছেই না। স্প্যানিশ ক্রীড়া দৈনিক মার্কার প্রতিবেদন অনুযায়ী বার্সেলোনার সাবেক পরিচালক টনি ফ্রেইজা নেমে পড়েছেন আসরে। এমনিতেই ‘ভার’ চালু হওয়াটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। বার্সেলোনার গত ১১ বছরের ঘরোয়া সাফল্যের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘১১ বারের মধ্যে আটবারের লিগে কী এমন ক্ষতিটা হয়েছে।’
পিকের সাম্প্রতিক বক্তব্যের প্রতিধ্বনি তুলেছেন তিনি, ‘তারা ভারকে প্রতারণার হাতিয়ার বানিয়ে ফেলেছে। গত দুদিনে যা দেখলাম, তাতে রিয়াল মাদ্রিদের পয়েন্ট হারানোটা দুরূহ।’
বার্সেলোনা কোচ কিকে সেতিয়েন মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন। তিনিও যথেষ্টই ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। একসময় আনাতোলি কারপভের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ুর সঙ্গে দাবা খেলেছেন, মস্তিষ্ক শীতল। রিয়াল মাদ্রিদের ‘ভার-আনুকুল্য’ নিয়ে স্পষ্ট কোনও কথা বলেননি। সোমবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘কালকের ম্যাচে কী ঘটেছে সবাই তা দেখেছে। প্রত্যেকেরই নিজস্ব মতামত দেওয়ার অধিকার আছে। আর ঘটনা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। সেটির ওপর আমরা নির্ভরও করে বসে নেই। আমাদের শুধু জিততে হবে।’
সেতিয়েনের সব চিন্তাই আপাতত ন্যু ক্যাম্পে মঙ্গলবারের আথলেতিক বিলবাও ম্যাচ নিয়ে, ‘আমরা সবাই জানি আথলেতিক খুবই শক্ত দল। তারা রক্ষণে দুর্দান্ত, তাদের হারানো কঠিন।’
আথলেতিক চলতি লা লিগার প্রথম ম্যাচে বার্সেলোনাকে হারিয়েছে, কোপা দেল রে থেকে ছিটকে ফেলেছে কাতালান পরাশক্তিকে। সেতিয়েন সত্যটা জানেন। দিনশেষে দায় কিন্তু তাকেই নিতে হবে। এমনিতেই কথা উঠে গেছে, ভালভার্দেকে বদলে কীইবা হলো? সেই তো ভালভার্দের মতোই দলকে খেলাচ্ছেন সেতিয়েন। কোনও সৃষ্টিশীলতা নেই, খেলার মধ্যে কোনও চমক নেই!
Leave a Reply