চীন-ভারতের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে আগ্রহ দেখিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর আগে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধপূর্ণ কাশ্মির ইস্যু নিয়ে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। পাকিস্তান সাড়া দিলেও ভারত দেয়নি। সর্বশেষ দেখা যাচ্ছে ভারত-চীনের সীমান্ত সংঘাতে মধ্যস্থতা করতে রাশিয়াও হয়তো এগিয়ে আসবে। ভারত ও চীনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঠিক আট দিনের মাথায় ২৩ জুন রাশিয়া, চীন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এক ভার্চুয়াল বৈঠকে মিলিত হওয়ার কথা রয়েছে। যদিও তিন দেশের এই বৈঠক অনেক আগে থেকে নির্ধারিত ছিল, কিন্তু লাদাখের সীমান্ত সংঘাতের পর ভারতের তাতে যোগ দেওয়া অনিশ্চিত ছিল। কিন্তু রাশিয়ার অনুরোধেই নাকি শেষ পর্যন্ত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এই বৈঠকে আসতে সম্মত হয়েছেন।
এই মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতের একমাত্র বন্ধুরাষ্ট্র। চীন-ভারত সংঘাতে বাংলাদেশের ভূমিকা তাহলে কী? সম্প্রতি চীনের বাজারে নতুন করে বাংলাদেশের ৫ হাজার ১৬১টি পণ্যেকে শুল্কমুক্ত প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে দেশটি। তাকে বাঁকা চোখে দেখছে সরকারি ইশারায় চলা ভারতীয় মিডিয়া। এটিকে চীনের ‘খয়রাতি সাহায্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছে তারা। তাদের ভাষ্য, ভারতের সঙ্গে চীনের চলমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে বেইজিংয়ের এই পদক্ষেপ ঢাকাকে কাছে টানার প্রচেষ্টা। আবার হঠাৎ করে ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ডজনখানেক ‘ভাড়াটিয়ে’ দিয়ে আয়োজিত ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী অটুট রাখার ব্যানার নিয়ে দাঁড়ানো মানববন্ধনকে ভারতের মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করেছে বাংলাদেশের জনগণ চীন-ভারত সংঘাতে চীনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেমেছে। ভারত-বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মৈত্রীর কোনও ঘাটতি দেখা না দিলেও, এ ধরনের মানববন্ধনের নেপথ্য আয়োজক কে, মানুষ ঠিকই জানে। তাই আমার সন্দেহ ঢাকা-দিল্লির রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক যতই মজবুত হোক, নরেন্দ্র মোদির আমলে ভারতীয় মিডিয়ায় নোংরা জাতীয়তাবাদী ভূমিকা, সাম্প্রদায়িক উসকানি দু’দেশের জনগণের মধ্যেকার সম্পর্ক আগের মতো নেই।
দু’দেশের সম্পর্কের প্রধান খুঁটি এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার আমলে ভারত যে আন্তরিক সহযোগিতা বাংলাদেশ থেকে পেয়েছে তার প্রতিদান দেশটি শেষ করতে পারবে না বলে ভারতের বুদ্ধিজীবী সমাজ বহুবার বলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও ৩০ মে ২০১৮ সালে গণভবনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমরা ভারতকে যেটা দিয়েছি তারা তা সারা জীবন মনে রাখবে। প্রতিদিনের বোমাবাজি গুলি থেকে আমরা তাদের শান্তি ফিরিয়ে দিয়েছি। এটা তাদের মনে রাখতে হবে।’
আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাইলে চীন-ভারতের উত্তেজনা প্রশমনে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করতে পারবেন। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে চীন-ভারত উভয়ের সুসম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তার একমাত্র বন্ধু বাংলাদেশ হাতছাড়া হচ্ছে—এই শঙ্কায়ও থাকতে হবে না। কেউ কেউ মনে করতে পারেন বাংলাদেশের সেই ‘ওজন’ কোথায় যে মধ্যস্থতার ভূমিকায় যেতে পারে! ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের সময় দক্ষিণ এশিয়ার আরেক নারী শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি সকালে দিল্লি থাকলে রাত্রে পিকিং থাকতেন। কতটুকু প্রভাব খাটাতে পেরেছিলেন জানি না, তবে চীন তার দখল করা ভারতীয় জায়গা ছেড়ে দিয়ে তার নিজ সীমান্তে চলে গিয়েছিল।
১৫ জুন, ২০২০ হিমালয় পর্বতমালায় চীন-ভারতের বিরোধপূর্ণ সীমান্ত অঞ্চলে দুই দেশের সৈন্যদের মধ্যে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে তার জের কোথায় থামে আমরা কেউ জানি না। দুই দেশের যুদ্ধ বাধলে বাংলাদেশও নিরাপদ নয়। ১৫ জুন ২৩ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছে। ভারতীয় মিডিয়ার দাবি করছে তারা চীনের ৪৫ সেনাকে হতাহত করেছে। চীন এখনও তার ক্ষয়ক্ষতি বিস্তারিত বলেনি, তবে ২২ জুন দু’পক্ষের বৈঠকে একজন সেনা কমান্ডারের মৃত্যুর কথা বলেছে। হতাহতের সংখ্যা ভারতের চেয়ে কম নয়, এটা তাদের কথাবার্তায় বোঝা যায়।
ভারতের অভিযোগ, গালওয়ান উপত্যকায় লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলওএসি) মেনে চলার অঙ্গীকার মানছে না চীন। চীনের অভিযোগ, ভারত সোমবার দু’দফায় ‘সীমান্ত লঙ্ঘন করে, উসকানি দেয় এবং চীনের সৈন্যদের আক্রমণ’ করে, যার ফলশ্রুতিতে দুদেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এনডিটিভি জানায়, ২২ জুন প্রকাশিত ৫ মিনিটের বেশি এক মোবাইল ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে দু’পক্ষ হট্টগোল করছে, তখন এক ভারতীয় জওয়ান চীনা অফিসারকে ঘুষি মারছে।
এই সংঘাতের পর উভয় পক্ষ লাদাখ সীমান্তে স্থল সেনা ও বিমান সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে একটা নিয়মিত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আবার মেজর জেনারেল অফিসার পর্যায়ে উভয় পক্ষ আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রেখেছে। এই আলোচনার ফাঁকে যে ১০ ভারতীয় সেনা সদস্যকে ১৫ জুন ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাদেরকে ভারতের হাতে প্রত্যর্পণ করেছে চীন।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, যে এলাকায় সংঘাত হয়েছে সেই এলাকাকে চীন কখনও তাদের এলাকা বলে দাবি করেনি, কিন্তু সংঘাতের পর চীন দাবি করছে গালওয়ান উপত্যকার অধিকার সব সময় চীনাদের। এইভাবে চীন এই যাবৎ সর্বমোট সাত হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার ভারতীয় জায়গা গ্রাস করেছে। জওহরলাল নেহরুর সময় থেকে এসব এলাকাকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা হতো। আকসাই চীনের মধ্যে দিয়ে চীনের রাস্তা নির্মাণের প্রথম খবর যখন বেরিয়েছিল, তখন লোকসভায় নেহরু ঘোষণা করেছিলেন—জনমানব শূন্য পাথুরে পার্বত্য এলাকায় একগাছি ঘাসও জন্মায় না—‘নট এ ব্লেড অব গ্রাস গ্রোস’। কিন্তু ১৯৪৯ সালে পিকিং-এ কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠার পর মাও সে তুং একটা কাজও অহেতুক করেননি। শুধু পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন।
নেপোলিয়ন চীনকে উপলক্ষ করে বলতেন, এশিয়ার ঘুমন্ত সিংহ। জাগলে বিশ্বকে নাড়া দেবে। নেপোলিয়ন ফরাসি বিপ্লবের জুনিয়র পার্টনার। চার দশক ইউরোপকে হাতের তালুতে নিয়ে নাচিয়েছেন। সুতরাং তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে চীন সম্পর্কে যে কথা বলেছিলেন, তাইতো আজকের বাস্তবতা। পণ্ডিতেরা বলেন, মাও সে তুং চীনে বিপ্লব সমাধান করেছিলেন, দেং জিয়াওপিং চীনের অর্থনীতির দ্বার উন্মোচন করেছিলেন, আর বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং চীনকে দুনিয়ার শীর্ষে পৌঁছাবেন।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতা গ্রহণ ছিল দিল্লির শাহেনশাহ স্টাইলে। সার্কের দেশগুলোর পাশাপাশি মরিশাসের নেতা তার শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফসহ শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে, আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফরে থাকায় এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। ভারতের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চার (ইউপিএ) সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীও উপস্থিত হন মোদির শপথে।
কিন্তু কয়েক বছর না যেতেই দেখা যাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার দেশের মুসলমান নির্যাতন শুরু করেছে। দ্বিতীয় দফায় এসে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নিয়েছে। লাদাখকে কাশ্মির থেকে আলাদা করেছে। অর্থনৈতিক দুরবস্থাসহ দেশজুড়ে অশান্তি তৈরি করেছে। অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া কারও সঙ্গে সম্পর্ক ভালো নেই। বাংলাদেশিদের নিয়ে বিজেপির শীর্ষ নেতারা বাজে মন্তব্য করছেন। দাদাগিরির মনোভাবের কারণে নেপালের সঙ্গে পর্যন্ত সম্পর্ক খারাপ হয়েছে, অথচ নেপাল হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। সীমান্ত নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে নেপালের সঙ্গে ভারতের বিরোধ চলছে। ভারতের সেনাপ্রধানের একটি মন্তব্যকে ঘিরে বিরোধ আরও বেড়েছে। নেপাল তার নতুন মানচিত্রে ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের লিপুলেখ, কালাপানি ও লিম্পিয়াধুরার অঞ্চলগুলোকে নেপালি ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে দেখিয়েছে। এ নিয়ে দু’দেশের মধ্য উত্তেজনার ধারাবাহিকতায় বিহার সরকারকে সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় বাঁধ সংস্কারের কাজ বন্ধ করতে বাধ্য করেছে নেপাল। তাদের দাবি, বাঁধটি নো ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থিত।
বহুদিন দেখেছি ভারত পাকিস্তানকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতো। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি সরকার মনে করতে শুরু করেছে চীনই তার প্রতিদ্বন্দ্বী। আকারে আর জনসংখ্যায় ভারত চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার যোগ্যতা রাখে সত্য, কিন্তু বাস্তবতা হলো চীন অগ্রগতি বিবেচনায় ভারতকে বহু পেছনে ফেলে এসেছে। আমেরিকা এই অঞ্চলে ভারতকে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তৈরি করতে চাওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু চীন আর ভারতের মধ্যে যে তারতম্য সৃষ্টি হয়েছে তাতো ভারতের পক্ষে আমেরিকা সাহায্য করলেও আর পূরণ করা সম্ভব না। ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব নিয়ে চললে প্রতি পদে পদে বিরোধে জড়াতে হবে।
চীন ‘এক চীন’ নীতিতে বিশ্বাসী। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় আমেরিকা যখন গোপনে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে, তখনও চীনের শর্ত ছিল আমেরিকা যদি ‘এক চীন’ নীতিতে বিশ্বাসী হয়, তখন চীন আমেরিকার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সম্মত হবে। কিসিঞ্জার তাই করেছিলেন—চীনকে ভেটো পাওয়ারসহ জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য করার সব বাধা অপসারণ করে। আর তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে আমেরিকা চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পদক্ষেপ শুরু করে। অথচ নরেন্দ্র মোদি সরকার তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে দুই জন প্রতিনিধি পাঠিয়েছে। এতে চীন ক্ষ্যাপারই কথা। আমেরিকা যেখানে দুই চীন নীতি পরিত্যাগ করেছে, সেখানে ভারত বাড়াবাড়ি করার পরিণাম তো ভোগ করবেই।
ভারত স্যাটেলাইট দিয়ে দেখেছে চীন গালওয়ান নদীর গতিপথ পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। তারা ব্রহ্মপুত্রের গতিপথও পরিবর্তন করতে চেয়েছে, তার প্রবাহ গোবি মরুভূমিতে নিয়ে যাবে বলে। ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পরিবর্তন করলে শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারতের উচিত হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ পরিহার করে সমঝোতায় আসার। চীনের পত্র-পত্রিকা বলছে যুদ্ধ হলে ভারত তিনদিক থেকে নাকি আক্রমণের শিকার হবে। চীন নাকি নেপালকেও ভারত আক্রমণের জন্য উৎসাহিত করছে এবং অস্ত্রের জোগান দিচ্ছে। নেপালের গোর্খা বাহিনী প্রচণ্ড যোদ্ধা। আরেকদিকে আছে পাকিস্তান।
চীনা মোবাইল ফোন বর্জন, টিভি ভাঙাভাঙি করলেই সংঘাত শেষ হবে না, দরকার দুপক্ষের আলাপ আলোচনা, গ্রহণযোগ্য মধ্যস্থতা। যুদ্ধের চেয়ে সমঝোতায় উত্তম।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
Leave a Reply