বলা হয়ে থাকে, সময় ও পরিস্থিতির দাবিতে মানুষের হাতে রাজনৈতিক প্রয়োজনে রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে। যদিও প্রাচীন গ্রিসে রাজনীতি হিসেবে সরকার গঠন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অনুশীলন ছিল, কিন্তু সেই অর্থে রাজনৈতিক দল সেখানে কার্যকর ছিল বলে জানা যায় না। আঠারো ও উনিশ শতকে এসে প্রথমে ইউরোপে ও পরে আমেরিকায় আমরা প্রকৃত অর্থে আজকে যাকে রাজনৈতিক দল বোঝায় তার জন্মগ্রহণ দেখতে পাই। সে বিচারে যুক্তরাজ্যের কনজার্ভেটিভ পার্টি বা টোরি দল এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক পার্টি সবচেয়ে বয়স্ক রাজনৈতিক দল এ পৃথিবীর। আর ভারত উপমহাদেশে জাতীয় কংগ্রেস হচ্ছে সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল, জন্ম ১৮৮৫ সাল। তারপর ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি এবং তারও পরে ১৯০৬ সালে এসে জন্ম নেয় মুসলিম লীগ। পৃথিবীর অন্য অংশে অর্থাৎ আজকে যারা নিজেদের গণতন্ত্রের সূতিকাগার দাবি করে, তাদের সঙ্গে তুলনায় ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসও কম পুরনো নয়। বিশেষ করে রাজনীতির বা রাজনৈতিক দলের। মজার ব্যাপার হলো, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের একচ্ছত্র রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে যে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলটি ১৯০৬ সালে প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ সহযোগিতায় জন্ম নিয়েছিল তা স্বাধীন পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার মাত্র দু’বছরের মাথায় ভেঙে গিয়ে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হওয়া এবং আরও চার বছর পরে এসে দলটির নাম থেকে একটি সুনির্দিষ্ট ধর্মপরিচয় সরিয়ে সর্বজনীন ও সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের জন্য উন্মুক্ত রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের যে ইতিহাস, তাই-ই আসলে ‘আওয়ামী লীগ’ তথা উপমহাদেশের নবীন ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে সৃষ্ট রাষ্ট্র বাংলাদেশের ইতিহাস।
একটি রাজনৈতিক দলের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে আমরা একটি জাতির জন্ম-ইতিহাস জানতে পারি, একটি স্বাধীন দেশের জন্ম-ইতিহাস জানতে পারি এবং তারপর এই দলটির ইতিহাসের সঙ্গে আমরা হেঁটে আসতে পারি একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর ধারাবাহিক ইতিহাস থেকে। এদিক থেকে যুক্তরাজ্যের কনজার্ভেটিভ দল, যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক দল এবং ভারতের কংগ্রেসের সঙ্গে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগকে তুলনা করা যেতে পারে, কারণ এদের প্রত্যেকেরই নাম জড়িত একটি জাতি, একটি দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের সঙ্গে।
পৃথিবীর এসব পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল এখনও শক্তিশালী ও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে রাজনীতি করে যাচ্ছে এবং সরকার পরিচালনা করার সুযোগ পাচ্ছে, কারণ দলগুলো শুরু থেকে এ পর্যন্ত বহুবিধ পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের ভেতর দিয়ে এগিয়েছে। অনেক সময় তিন কদম আগাতে গিয়ে দু’কদম পেছাতে হয়েছে, পড়তে হয়েছে রাজনীতি ও অপকৌশলের গর্তে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আওয়ামী লীগের মতো ভয়ঙ্কর ও নির্মম নিষ্পেষণের ভেতর কোনও সভ্য দেশের রাজনৈতিক দলকে কখনও পড়তে হয়েছে বলে আমরা প্রমাণ পাই না, অন্তত আলোচিত তিনটি রাজনৈতিক দলের কোনোটিকেই কখনও আওয়ামী লীগের মতো দুঃসময় পার হতে হয়নি। কারণ, এসব দেশের কোনোটিতেই এখনও পর্যন্ত অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে, জনগণের অর্থ দিয়ে কোনও প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল গঠনের নজির নেই। হ্যাঁ এসব দেশেও নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ইতিহাস রয়েছে, কিন্তু রাজনীতিটি সব সময় সময়ই নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পন্থায় জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর হাতেই ছিল। ফলে চ্যালেঞ্জগুলোও ছিল মূলত রাজনৈতিক। কিন্তু পাকিস্তান আমলেও আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল বন্দুকধারী ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রবল ক্ষমতাধর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ দুই-দুইজন স্বৈরশাসক ও তাদের হাতে বাংলাদেশের সেনানিবাসে জন্ম নেওয়া দু’টো রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ নিয়ে যেকোনও আলোচনায় আমাদের এই নির্মম সত্যটাকে বিবেচনায় রেখেই আলোচনা করতে হয় এবং এ কারণে অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত ও সর্বার্থে নিরপেক্ষ আলোচনা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না।
রাজনৈতিক দল তাদের ও সময়ের প্রয়োজনে রাজনীতির কৌশল বদলাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই যে শুরু থেকেই অর্থাৎ মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ নাম নেওয়ার মধ্য দিয়ে যে এই দলটি বারবার তাদের কৌশলই পরিবর্তন করেছে তা নয়, আজকে যে আওয়ামী লীগকে আমরা দেখতে পাই, তা হয়তো এই উপমহাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক কাঠামোতে একটি ‘সাধারণ’ রাজনৈতিক দল, যার রাজনীতি ও কৌশলকে আমরা অন্য আর দশটি রাজনৈতিক দল থেকে আলাদা করতে পারি না। কিন্তু তারপরও এখন পর্যন্ত উপমহাদেশে কিংবা কেবলমাত্র বাংলাদেশে যতটুকু রাজনীতির চর্চা অবশিষ্ট রয়েছে, নীতির ভিন্নতার ক্ষেত্রে যতটুকুই চর্চা অবশিষ্ট রয়েছে, এসবের অনেকখানিই এখনও পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে উপস্থিত দেখতে পাওয়া যায়। সে তুলনায় বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল মূলত মৌসুমি রাজনীতিতে অভ্যস্ত, ‘সরকারে যাওয়া এবং গিয়ে দেশ চালানোর’ বাইরে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ কিংবা রাজনীতির চর্চা ঠিক ঠাহর করা যায় না। এর কারণ হয়তো এটাই, এদের বেশিরভাগই (কমিউনিস্ট পার্টি, জামায়াতে ইসলামী’র মতো রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়া) গঠিত হয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতার বদৌলতে, রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ও টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে, ফলে যখনই তারা রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়েছে, তখনই তারা প্রকৃত রাজনীতি করা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ কিংবা কমিউনিস্ট পার্টির ওপর হামলা চালিয়েছে, নেতৃত্বশূন্য করার মিশন নিয়ে নেমেছে এবং ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্ট ঘটানোসহ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে হত্যা করেছে।
জন্মের পর থেকে ‘অ্যাচিভমেন্ট’ বলতে পাকিস্তানের মতো একটি অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ভেঙে ফেলে তার ভেতর থেকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়াকে যদি সর্বোচ্চ সফলতা হিসেবে ধরি, তাহলে তার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে বাংলাদেশ নামক একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন, দু’টি সামরিক সরকার ও তাদের গড়া রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকা, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে আদর্শ মেনে (কতটা কার্যকরভাবে সেটা প্রয়োগ করতে পেরেছে, তা নিয়ে বিস্তর তর্ক চলতে পারে) এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশকে তার আলোকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, সপরিবারে জাতির পিতা হত্যার বিচার সম্পন্ন করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখা, স্বাধীনতাবিরোধী ও রাজাকারের বিচার কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা এবং সর্বোপরি শুরু থকেই একটি সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই দেশের মানুষের ভাগ্য বদলে নিরঙ্কুশ চেষ্টাকে অব্যাহত রাখার মতো বিষয়গুলোকেও সফলতা হিসেবে বিবেচনায় রাখতে হবে।
পৃথিবীর অন্য যেকোনও দেশের রাজনৈতিক দলের মতোই আওয়ামী লীগকেও দেশের ও সামগ্রিকভাবে বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হয়েছে এবং হচ্ছে। ব্রিটেনের কনজার্ভেটিভ দলে অ-শ্বেতাঙ্গ কিংবা খ্রিস্টধর্মের বাইরে অন্য কোনও ধর্মে বিশ্বাসী কেউ কখনও সদস্যপদ পাবে, সেটা এই সত্তর/আশির দশকেও ভাবতে পারাটা কঠিন ছিল, এখন এই দলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট দলে কালো প্রেসিডেন্ট পদে কাউকে দেখা যাবে সেটাও নব্বইয়ের দশকে কেউ ভাবেনি। ওদিকে ভারতে আজ কংগ্রেসকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে বিজেপি’র মতো একটি সাম্প্রদায়িক ও বিভেদ সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক দলকে, ক্ষমতাহীন হতে হতে ভারতের আঞ্চলিক দলের সক্ষমতার কাছেও কংগ্রেসকে কখনও কখনও ম্লান মনে হচ্ছে। এই পরিবর্তন এবং বিশ্বের বিখ্যাত রাজনৈতিক দলগুলোর পরিবর্তিত রাজনীতি দেখে আওয়ামী লীগকে তো আসলে ভাগ্যবানই বলতে হয়, এ কারণে যে, ৭৫-এর ১৫ আগস্টের পরে বাংলাদেশে যে আওয়ামী লীগ নামে কোনও রাজনৈতিক দল থাকবে সেটাই তো কল্পনায় ছিল না অনেকের। এরপর আবার ২১ আগস্ট, যেকোনও রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই এরপরে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য অচিন্তনীয় ইচ্ছাশক্তি ও প্রতিবাদী হতে হবে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
এরসঙ্গে যুক্ত করা দরকার, পাকিস্তানের ‘সিভিল-মিলিটারি বিবাহ’ স্বাধীন বাংলাদেশেও তীব্রভাবে লক্ষ্যমান এবং তাদের চোখে আওয়ামী লীগ এক ও অনন্য শত্রু, এবং সেই সঙ্গে আরও যুক্ত করা দরকার আন্তর্জাতিক শক্তিবলয়ের বিরোধিতাও, যারা মূলত বাংলাদেশে তাদের ‘পাপেটকেই’ ক্ষমতায় দেখতে ও রাখতে অভ্যস্ত। এই বহুবিধ বিরোধী পক্ষগুলোর চলমান ও ক্রমাগত শত্রুতার বলয় থেকে বেরিয়ে, তাদের সঙ্গে নিয়েই দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা করার যে নজির আওয়ামী লীগ সৃষ্টি করতে পেরেছে, তার জন্য তাকে মূল্যও কম দিতে হয়নি বা হবে না। এরমধ্যে মহামূল্যবান যা আওয়ামী লীগ হারিয়েছে বা ক্রমাগত হারাচ্ছে, তাহলো দলটির বিশাল সমর্থকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠতা, একটি পরিবারের মতোই দলটির সকল নেতাকর্মীসমর্থক নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকায় দলটি সকল প্রকার বিঘ্ন অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল অতীতে, কিন্তু দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকার কারণে এই সম্পর্কে চিড় ধরেছে, তৈরি হয়েছে দূরত্ব। কিন্তু এটাও সত্য, দল ও সমর্থকদের মধ্যে তৈরি হওয়া দূরত্ব কিংবা জনগণের আস্থা কমে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট ফাঁক-ফোকরগুলো পূরণ করার মতো রাজনৈতিক শক্তিও বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নেই, আর সে কারণেই আজকের আওয়ামী লীগের বিকল্পও এর চেয়ে ভালো আওয়ামী লীগই, অন্য কোনও রাজনৈতিক দল নয়। ভারতে কংগ্রেসের ব্যর্থতায় বিজেপি’র উত্থান ঘটে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতায় অন্য কোনও রাজনৈতিক দল যে সে স্থান নেবে, এরকম রাজনৈতিক দলই এদেশে গড়ে ওঠেনি, এই ব্যর্থতা কার সে বিষয়েও আলোচনা চলতে পারে। পাকিস্তানের দিকে তাকালে যে ভয়টা দৃঢ় হয় তাহলো, পাকিস্তানে ‘সিভিল-মিলিটারি বিবাহ’ মুসলিম লীগকে ব্যর্থ করেছে, পিপলস পার্টিকে ব্যর্থ করেছে, নওয়াজের মুসলিম লীগকে ব্যর্থ করেছে, এখন আবার নিজেদেরই তৈরি ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআই-কেও ব্যর্থ করতে চলেছে। বাংলাদেশ সে ভয় মুক্ত হয়েছে বলেই আপাতঃভাবে বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু ভবিষ্যৎ, সেতো কেবল ভবিষ্যৎই জানে।
৭১ বছর বয়সী বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন, পরীক্ষিত ও প্রতিবাদী রাজনৈতিক দলটিকে অভিনন্দন। সমালোচনাটুকু তুলে রাখছি আর কোনোদিন লেখার জন্য।
লেখক: সাংবাদিক
Leave a Reply