জাহাঙ্গীর আলম : বন্ধু জহির আজ নয় বছর পর জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে, ধর্ষনের দায়ে নয় বছরের জেল হয় জহিরের, গতকাল তার সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে। দির্ঘদিন জেলে কাটানোর পর, বাইরের পৃথীবি দেখলে আনন্দিত হওয়ার কথা জহিরের, অথচ তার করুন চোখের চাহুনি সেটা জানান দিচ্ছে না, কেন দিচ্ছে না সে প্রশ্ন করলাম না। জেল থেকে বের হয়ে ও মেঘলার কথা জিজ্ঞেস করলো!
মেঘলা কেমন আছেরে?
সে অনেক কথা, আগে বাসায় চল।
ওকে নিয়ে ফরিদপুর জেলগেট থেকে রিকসায় উঠলাম, এরপর বাসে, ফরিদপুর থেকে এলাকায় আসতে মোটামুটি বাসে ঘন্টা দেড়েক সময় লাগে, এতদিন পরে এত কাছের বন্ধুকে পেয়েও খুব একটা গল্প জমাতে ইচ্ছা করলো না, সেদিন সব রকম চেষ্টা করেও ওকে পুলিশের হাত থেকে বাচাতে না পারার জন্য একপ্রকার লজ্জাবোধ কাজ করছে আমার মাঝে। ফরিদপুর থেকে এলাকায় আসার রাস্তা আগের মত নেই, এখন রাস্তাটা অনেক ভাল, বাসের দুলনিতে গা এলিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম, আমার পাশে বসে আছে জহির। আর একে একে নয় বছর আগে ঘটে যাওয়া দৃশ্যগুলো ভেসে আসছে চোখের সামনে। জহির তখন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের অনার্সের ছাত্র। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ, রেজাল্ট আসার আগ পর্যন্ত কলেজ বন্ধ থাকার সুবাদে গ্রামের বাড়িতে চলে আসে জহির। কিছুদিন বাদে প্রতিবেশী মেঘলার সাথে ঘনিষ্ট হয়। পরিচয় থেকে আস্তে আস্তে দুজনের মাঝে মন দেয়া নেয়ার পর্বটাও চুড়ান্ত হতে বাকি থাকে না। ভালবাসার অতি আবেগে একদিন বিকালে দুজনে ঘুরতে বের হয় একটু দুরে। কে জানতো এই ঘোরাফেরাই ওর জীবনে কাল হয়ে দাড়াবে!!! কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওদের ঘিরে ফেলে এলাকার কিছু বখাটে যুবক। কি নাম? বাসা কই? সাথে কে? এখানে কি? ইত্যাদি প্রশ্নে ভয় পেয়ে যায় জহির। শেষ পর্যন্ত চুপচাপ চলে আসতে চাইলেও বখাটেদের থেকে শেষ রক্ষা হয়নি জহিরের। ওখানে আটকে রেখেই জহির এবং মেঘলার অভিভাবকদের খবর দেয়া হয়, এলাকায় রব উঠে যায় জহির এবং মেঘলা আপত্তিকর অবস্থায় ধরা খেয়েছে!! মুহুর্তেই লোকজন ভিড় করতে থাকে ঘটনাস্থলে।
মেঘলা কাদছে, জহির তার কান্না থামানোর চেষ্টা করছে না, সে নির্বাক হয়ে গেছে, এই মুহুর্তে পৃথীবির সব থেকে ঘৃন্য মানুষ সে।যদি ঘৃন্যই না হবে তাহলে তাকে দেখতে এভাবে গ্রামের মানুষ ছুটবে কেন? নানান মানুষ নানান টিপ্পনি কাটছে জহির এবং মেঘলাকে নিয়ে। একজন বৃদ্ধের অশালীন মন্তব্য জহিরের বুকে এসে বিধলো, শালারা চুলকানী মিটাবা বাড়িঘর চোখে দেখোনা? ফাকা মাঠে চুলকানী মেটানো লাগে? জহিরের বাবা মা ঘনটাস্থলে আসার আগেই অতি উৎসাহী কেউ একজন থানায় খবর দিয়েছে। মুহুর্তেই পুলিশের গাড়ি হাজির। জহির এবার পুলিশের পায়ে জড়িয়ে ধরলো, বিশ্বাস করেন স্যার আমরা কোন অন্যায় করিনি, ঘুরতে আসছিলাম শুধু।আমাদের থানায় নিবেন না। সামনে আমার পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে। আমার ভবিষ্যত নস্ট হয়ে যাবে। দারোগা সাহেব কোন কথার কর্নপাত করলেন না। ওদের গাড়িতে ওঠানো হলো। এই ঘটনা পুরো এলাকায় প্রকাশ হতে খুব একটা সময় লাগলো না, এলাকার কয়েকজন সাংবাদিক ছুটলেন থানায়। সাংবাদিক সাহেব ছেলে এবং মেয়ের সাথে দেখা করার অনুমতি পেলেন,ওদের থেকে সমস্ত ঘটনা শুনলেন। অনেকদিন পর জটিল একটা কেস পাওয়া গ্যাছে, মোটা অংকের দান মারা যাবে নিশ্চই। সাংবাদিক সাহেব তার সঙ্গিদের খবর দিলেন। থানার বারান্দায় বসে আছে মেয়ে এবং ছেলের বাবা মা, ওসি সাহেব থানায় নেই, ওসি না আসা পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হবে।ওসি সাহেব ছাড়া এই ব্যাপারটার সমাধান কেউ দেবে না। অগত্যা তার অপেক্ষায় এভাবেই বসে থাকা। সাংবাদিক সাহেব মেয়ের বাবাকে ডাকলেন।
মুরব্বী, যতদুর জানলাম ঘটনাতো জটিল, এখন কি করতে চান?
বাবা আমার মাইয়াডার কোন দোষ নাই, পোলাপান মানুষ, ভুল কইরা প্রেমের সম্পর্কে জড়ায় গ্যাছে। এলাকার পোলাপান আমার মাইয়ার নামে মিথ্যা অপবাদ দিতাছে। আমি আমার মাইয়ারে নিয়া যাইতে চাই।
এমনিতেই নিয়ে যাবেন? আপনার মেয়েকে ফুসলিয়ে নিয়ে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করলো যেই ছেলে, তার বিচার চাননা?
কিসের বিচার চামু বাবা? আমার মেয়ে ঘুরতে গেছিল। এলাকার পোলাপান ষড়যন্ত্র কইরা তাগো আটকাইছে।
-মুরব্বী, এককাজ করেন, ওসিসাব আসলে বলবেন আপনার মেয়েকে বিয়ের প্রলোভন দিয়ে ধর্ষন করা হইছে, মোটা অংকের টাকা না হলে আপোষ করব না। যদি রাজি হন টাকা আদায়ে আমরা আপনার সাথে থাকব, আমরা সাংবাদিক, ওসি সাহেবরে যা বলব তিনি শুনবেন। টাকা যা পান সেখান থেকে আমাগো খুশি করায় দিয়েন।
-এসব কি কন। বাপ হইয়া মেয়েরে নিয়ে এমন জঘন্য কথা কমু? আমি পারুম না।
-এই বুড়াতো বেশী বোঝে, আপনি আপনার মেয়ের নামে যে দুর্নাম রটলো, যে এসবের জন্য দায়ী তার বিচার চাননা?
অনেক বুঝিয়েও মুরব্বীকে রাজি করাতে পারলেন না সাংবাদিকগন। এদিকে দিন গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে, মোটা অংকের টাকা হাতানোর জন্য গুটিকয়েক সাংবাদিকের কতরকম চেষ্টা। একবার মেয়ের অভিভাবকের কাছে যায়তো আর একবার ছেলের অভিভাবকের কাছে। আপাতত পত্রিকায় সংবাদ ছেপে দু পয়সা কামাই হওয়ার চান্স খুবই কম, এ কারনেই এসব ঘটনায় মধ্যস্থতাকারী হিসাবে নিজেদের নিয়োজিত করতেই নিজেদের ব্যাস্ত রাখেন তারা। কয়েকদফা হুমকি ধামকি, বিভিন্ন আইনের বুলি শুনিয়ে দুপক্ষকে একটা ভিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে সাংবাদিকগন। শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না দেখে জহির সিদ্ধান্ত দেয় মেঘলাকে বিয়ে করবে সে, এই প্রস্তাব মেনে নেয় মেঘলা এবং তার বাবা মা, খবরটা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে কথিত সাংবাদিক সাহেবের। সারাদিন কস্ট করে শিকার যোগাড় করে এখন শিকার হাতছাড়া হতে দিতে মন সায় দেয়না। মুহুর্তেই ক্যালকুলেটরে হিসাব কষে ফেলেন। অসম্ভব। এই মেয়ের বয়স এখন ১৭ বছর সাত মাস ২২ দিন। আইন মতে এই মেয়ের বিয়ের বয়স হয়নি। এই মেয়েকে বিয়ে দেয়া যাবেনা। বাধ সাধেন সাংবাদিক। এই দেশে ১০ বছরের মেয়ে ধর্ষিত হয়, সাংবাদিক কথা বলেনা, প্রভাবশালীর ১৫ বছরের মেয়ের বিয়ের দাওয়াত আয়েশ করে খেয়ে আসে সাংবাদিক, তখন বয়সের হিসাব করেনা, পার্কে, সিনেমা,ফাস্টফুডের দোকানে স্কুল পড়ুয়াদের অবৈধ কাজেও সাংবাদিক চুপ। বাধসাধে শুধু গরীবের বিয়েতে। ভেতর থেকে আওয়াজ আসে, সাংবাদিক সাহেব, আঠারো বছর আর সতের বছর সাত মাস খুব একটা ব্যাবধান নয়, তাছাড়া অন্তত মান সম্মানের দিকে তাকিয়ে……
সাংবাদিক তার কথায় অনড়, ছেলেপক্ষকে আড়ালে ডেকে আবার প্রস্তাব দেয়া হয়,
এই মেয়েকে বিয়ে কেন করতে যাবা? আমরা আছিনা? শালিস করে দিমুনে, যাতে মামলা না হয় বিয়েও না করা লাগে। এজন্য ওসি সাহেবকে কত দিতে হবে, কনেস্টবল দারোগাকে কত দিতে হবে, সাংবাদিককে কত দিতে হবে সব দরদাম ঠিক করে দেন তিনি। মেয়েটা এখন একেবারেই অসহয়, সমাজে তার বদনাম রটে গেছে, এই মেয়েটার এখন বিয়ের ব্যাবস্থা করা, কিংবা মুচলেকা নিয়ে বয়স হলেই ওই ছেলে ওই মেয়েকে বিয়ে করবে এমন ব্যবস্থা নেয়াটা সাংবাদিকের কাজ ছিল। কিন্তু টাকা যেখানে কথা বলায়, নিতিকথা সেখানে মুখ থুবড়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকের চাহিদা অনুযায়ী টাকা যোগাড়ে ব্যার্থ হয় উভয় পরিবার।এলাকার চেয়ারম্যান সাহেবও এই ছেলেমেয়ের দায়িত্ব এড়িয়ে যান। ওসি সাহেব কি করবে বুঝে উঠতে পারেন না, শেষ পর্যন্ত মেয়ের বাবাকে দিয়ে ধর্ষন মামলা করাতে রাজি করানো যায়। ওসি সাহেবের উক্তি ছিল।ছেলের নামে ধর্ষন মামলা দিলে পরবর্তীতে মামলা থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য হলেও তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হবে ওই ছেলে, যেহেতু এখন মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছো না, সেহেতু ধর্ষন মামলা দেয়াই উচিত কাজ। ধর্ষন মামলা হয়ে যায়, মেয়েকে থানা থেকে বাড়িতে নিয়ে যায় মেয়ের বাবা। ধর্ষন হয়েছে প্রমান করতে ডাক্তারকে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে আনা হয় সার্টিফিকেট। সেই থেকে আজ অবধি জেল খাটে জহির। মেয়ের বাবার সাথে আপোষ করে একটি দিনের জন্যেও জেল থেকে বের হতে চায়নি ও শুধুমাত্র অভিমানে। এরপর মেঘলাকে বিয়ে দেয়ার জন্য অনেক পাত্র দেখিয়েছে মেঘলার বাবা, এতসব ঘটনা জেনে কোন পাত্রই মেঘলাকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। নিজেকে ধীরে ধীরে ঘৃন্য কোন প্রানী ভাবতে থাকে মেঘলা। রাগে অভিমানে একদিন ফ্যানের সাথে ওড়না পেচিয়ে আত্তহত্যা করে মেঘলা। সামান্য টাকার লোভে অসহয় মানুষগুলোর কথা না ভেবে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে এতগুলো জীবন নস্ট করে দেয়া সেই সাংবাদিক এখন পাগল হয়ে চৌরাস্তায় বসে থাকে। বাস থেকে নেমে জহিরকে নিয়ে চৌরাস্তা দিয়ে হাটছি, আর ওই পাগল
সাংবাদিককে দেখে ভাবছি, সহজ সরল মানুষের প্রতি করা অন্যায়ের কেউ প্রতিশোধ নিতে না পারলেও প্রকৃতি ঠিকই একদিন এক এক করে সব অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়।
© All rights reserved 2000-2023 © kalerchaka.Com
Leave a Reply