বিভিন্ন সময়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)-সহ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার অনৈতিক কার্যক্রম ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রায়ই পুলিশ সদর দফতরসহ সংশ্লিষ্ট ইউনিটের পক্ষ থেকে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়ে থাকে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের অভিযোগ থাকে উপেক্ষিত। সাম্প্রতিক সময়ে থানার ওসিদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে। ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুশরাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেমের ক্ষমতার অপব্যবহার দেখেছে এদেশের মানুষ। পরে তার বিরুদ্ধে মামলা হলে সেই মামলায় তিনি এখন কারাগারে আছেন। বর্তমানে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাসের ক্ষমতার অপব্যবহার ও মাদক নির্মূলের নামে মানুষ হত্যার বিষয়টি দেশে-বিদেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় চলছে তোলপাড়। এ ঘটনায় মেজর সিনহার বোনের করা মামলায় ওসি প্রদীপ ও এসআই লিয়াকতসহ ওই থানার ৯ পুলিশ সদস্য এখন র্যাব হেফাজতে ও কারাগারে রয়েছেন। এসব চাঞ্চল্যকর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে, আসলে থানার ওসিদের সীমাহীন এই ক্ষমতার উৎস কোথায়, তারা চলেনই বা কার নির্দেশে?
পুলিশের সংশ্লিষ্ট ও অভিজ্ঞ সূত্র জানায়, থানার ওসিসহ পুলিশের সব সদস্য আইনের বিধি-বিধান অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে চলবেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা এগুলো মেনে চলেন না। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের আখের গুছিয়ে থাকেন। পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকেও বিভিন্ন সময় নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে যে—জনগণের কাছে নিজেদের মানবিক পুলিশ হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে।
সাবেক আইজিপি ও বর্তমানে সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানেরই কিছু আইন কানুন, বিধি বিধান ও গাইড লাইন আছে। আর একটা প্রতিষ্ঠান চলে তার নিজস্ব আইন কানুন দিয়ে। এখানে পুলিশের মধ্যে অনেক স্তর আছে। আইজিপির দেওয়া নির্দেশ স্তরে স্তরে যেতে যেতে কনস্টেবল পর্যন্ত যাবে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যা বলবে, সেই অনুযায়ী সবাই কাজ করবেন। পুলিশকে তো মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে হবে। পুলিশ সদস্য যেই এলাকায় কাজ করবেন, সেখানকার মানুষের সঙ্গে মানবিক আচরণ করবেন। এটাই পুলিশের কাছ থেকে মানুষ আশা করে।’
নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলি, যতদিন পুলিশ থাকবে ততদিন এগুলো আপনারা শুনবেন। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার আপাতত কোনও উপায় নেই। কেননা, পুলিশের ক্ষমতা আছে। যেখানে ক্ষমতা আছে—সেখানেই ক্ষমতার অপব্যবহার আছে। এজন্য ক্ষমতার অপব্যবহার যাতে না হয়, সেজন্যই এতগুলো স্তর রয়েছে পুলিশে। পুলিশের হাতে একটা অস্ত্র আছে। অস্ত্রের প্রয়োগটি কীভাবে করবেন— সেটাও আইনে বলা আছে। পুলিশে আইনের বই আছে। আইন কীভাবে প্রয়োগ করতে হবে, সেটাও বলা আছে। এগুলো মেনে তার ইউনিফর্মের মর্যাদা রাখবেন।’
সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ আরও বলেন, ‘পুলিশের মাঠ পর্যায়ের মূল ইউনিট হচ্ছে থানা। এই থানার ভালোমন্দ নিয়েই কিন্তু পুলিশের ভালোমন্দ নির্ধারিত হয়। অথচ দেখেন— থানায় কী হচ্ছে। আর থানার কাজগুলো কিন্তু সবাইকে দেখতে হবে। একজন জনপ্রতিনিধি বা রাজনীতিবিদ এলাকার ভালোমন্দ দেখবেন না? একটা মানুষ যদি হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হন, সেটা সেই জনপ্রতিনিধি বা রাজনীতিবিদ দেখবেন না? তাকে তো সোচ্চার হওয়া লাগবে যে, এই কাজটা অন্যায়, অপরাধ। এটা তুমি করতে পারো না। যদি এমন কোনও অন্যায় ও অনৈতিক কাজ দেখা যায়, তখন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বলতে হবে। তারাতো সমাজের বাইরে না। সমাজের ভালোমন্দ দেখার জন্যেই তো তারা রাজনীতি করেন। জনপ্রতিনিধি হয়েছেন।’
এখন প্রশ্নটা হচ্ছে—রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ সবাই যদি একসঙ্গে খারাপ কাজগুলো করেন, তাহলে আর কে দেখবেন। যেমন ফরিদপুরের ঘটনায় রাজনীতিবিদ, প্রশাসন ও পুলিশ সব এক হয়ে গেছেন। সব এক হয়ে গেলে তো হবে না। এখন এটার জন্য একটা শক্ত ব্যবস্থা কে নেবেন? আমরা তো প্রধানমন্ত্রীর কথা বলি। উনি কি সব কিছু দেখবেন? বলে দেবেন? আমি আমার স্বার্থে একটা কাজ করবো, সেক্ষেত্রে আমার যদি দায়িত্ববোধ না থাকে, তাহলে তো মুশকিল। আপনি ইচ্ছামতো আপনার স্বার্থে একটা কাজ করবেন। সবকিছু কি এক জায়গা থেকে আসা সম্ভব? সম্ভব নয়। এখন সবাই মিলে যদি আমরা কাজ করি তাহলে সম্ভব। না হলে বিচ্ছিন্নভাবে বলবেন—পুলিশের ক্ষমতা আছে পুলিশ সেই ক্ষমতা দেখাবে। যার শরীরে শক্তি নাই, তার হাতেও যদি একটা লাঠি কিংবা ছুরি বা একটা বন্দুক দেন, তখন দেখবেন তার কাছে আপনার-আমার মতো ১০ জনের শক্তি হয়ে গেছে। ক্ষমতা থাকলে ক্ষমতার অপব্যবহার করার চেষ্টা করবে যে কেউই। এই ক্ষমতার অপব্যবহার যাতে কেউ করতে না পারে, সেজন্য পুলিশের বিভিন্ন স্তরে তদারককারী কর্মকর্তাদের দেওয়া হয়েছে।’
সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ আরও বলেন, ‘এখন কক্সবাজারে পুলিশের ভূমিকার বিষয়ে এত কথাবার্তা শুনি। যদি এগুলো প্রমাণিত হয় যে অন্যায় হয়েছে, মানুষকে ভুগিয়েছে, তাহলে তাদের প্রত্যেকের চাকরি যাওয়া উচিত। শাস্তি হওয়া উচিত। মানুষ সাধারণত অপরাধপ্রবণ। যাতে এই অপরাধটা করতে না পারে—সেজন্য সুপারভিশনের কথা বলা হয়ে থাকে। এখন চাকরিজীবীরা যদি লাই পেয়ে যান, তাহলে তারা সেটা করতে থাকবেন। তাই লাই দেওয়া যাবে না। সবাই মিলে অপরাধীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। শুধু পুলিশই নয়, ক্ষমতা যে-ই দেখাবেন, সে যে চাকরিজীবীই হোক, তাকে ধরে হয় জেলে ঢুকাতে হবে, কিংবা বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হবে।’
বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন বলেন, ‘‘পুলিশকে আমরা দলীয় কাজে ব্যবহার করছি বেশি। কখনও আমরা পুলিশকে এমন কথা বলতেও শুনেছি যে—‘আমরাই তো সরকারকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছি।’ রাজনৈতিক কাজে আমরা পুলিশকে যেভাবে ব্যবহার করেছি, তার পূর্ণমাত্রায় সুযোগ নিচ্ছে পুলিশ। আর ওসিদের বিষয়টা হচ্ছে—তারা যখন একটা থানায় পদায়ন হন, তারা মনে করেন—ওই থানার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তারা। এসপিরা যখন জেলার দায়িত্ব পান তখন তারাও একইরকম ভাবেন। কারণ, এখানে কোনও চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নেই। অনেক আগে জেলা প্রশাসক এসিআর লিখতেন। তখন একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স ছিল। এখন সেটাও নেই।’
মানবিক পুলিশ তৈরির জন্য যে ধরনের প্রশিক্ষণ দরকার সেটা অনুপস্থিত। আর পুলিশের প্রমোশন, পদায়ন সবকিছুতে প্রভাব কিংবা দুর্নীতি কাজ করছে। ফলে একজন ওসি তার ঊর্ধ্বতনদের অজ্ঞাতে কিংবা প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় দানবে রূপান্তর হয়েছেন। আমরা যদি টেকনাফের ঘটনা লক্ষ করি, তাহলে দেখতে পাই, এই ওসি দীর্ঘদিন টেকনাফে নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে প্রকাশ্যে বিভিন্ন ঘোষণা দিয়েছেন, যা সোশ্যাল মিডিয়াসহ পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন সময় এসেছে। কিন্তু এটা যে আইনের বাইরের কাজ, আইন ও বিচারবহির্ভূত, এ বিষয়গুলো ঊর্ধ্বতনরা নজরে নেননি। যথাযথ পদক্ষেপ নেননি। বরং এ ধরনের কাজকে সফলতা দাবি করে তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। তাই এসব ঘটনার দায় ঊর্ধ্বতনরা এড়াতে পারেন না। তাদের যেভাবে সুপারভিশন করার কথা, তারা সেটা করছেন না। যার ফলে এ ধরনের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া শুধুমাত্র পুলিশকে দোষারোপ করেও আজকের অবস্থার উন্নতি করা সম্ভব নয়। এটার উন্নয়ন করতে গেলে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি বাদ দিতে হবে। দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজদের রাজনীতি থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হবে।’
Leave a Reply