এম.এম.লিয়াকত হোসেন লিটন: করোনাকালীন সময়ে যখন অনেক নারী উদ্যোক্তা ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে তখন ব্যবসা সম্প্রসারণ করে লাভের মুখ দেখছেন তানিয়া আক্তার। যিনি অনলাইনে মেয়েদের পোশাক বিক্রি করে নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন সেইসাথে অর্ধশত মানুষের কর্মসংস্থান করেছেন। ঢাকার ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ এবং ডেফোডিল ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ শেষ করে মাত্র দশ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন তানিয়া। কিন্তু এখন রাজধানীতে চারটি শোরুম এর মালিক তিনি। তার অনলাইন পেজ Colours Hill এর ফলোয়ার সংখ্যা সাত লাখের উপরে। বর্তমানে দেশের বাইরে আমেরিকা, ইংল্যান্ড , অস্ট্রেলিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক শহরে নিয়মিত যাচ্ছে তার পণ্য। বরগুনার মেয়ে তানিয়া মনে করেন সঠিক পরিকল্পনা, কঠোর পরিশ্রম আর সততার জন্যই তিনি এ পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছেন। তানিয়া যখন ব্যবসা শুরু করেন তখনকার গল্প বলছিলেন , তিনি বলেন ২০১৭ সালে আমি ও আমার এক বান্ধবী ঘরে বসে কাজ শুরু করি যা ছিল আমার এই ব্যবসার হাতে খড়ি। একজন মেয়ে হিসেবে মেয়েদের পছন্দ ও চাহিদা সম্পর্কে ভাল ধারনা ছিল, আর আমি সেটাকেই কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেই। শুরুতে আমরা পুরান ঢাকার ইসলামপুর থেকে কাপড় কিনে বাসায় বসে ডিজাইন করি এবং সেগুলো বিক্রি করি আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশী ও বন্ধুদের মাঝে। প্রথমদিকে ১৪-১৫ টি পোশাকের ডিজাইন করি যা বিক্রি হয়ে গেলে আরো ৩০ টি পোশাক তৈরি করি। এভাবেই শুরু। একদিন আমাদের কিছু ডিজাইন নিয়ে নিউমার্কেট ও ধানমন্ডির কয়েকটি শোরুমে দেখাই, যা উনারা খুবই পছন্দ করে। তখন বিভিন্ন শো রুম মালিক আমাদের কাছে পোশাক অর্ডার করতে থাকে এবং আমাদের কাজের পরিধি বাড়তে থাকে। এর মাঝে আমার বান্ধবীর শ্বশুরবাড়ি থেকে নিষেধাজ্ঞা আশায় ওর কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমি আমার স্বামীর সহযোগিতায় নতুন উদ্দমে কাজ শুরু করি। বিভিন্ন শোরুম মালিকদের অর্ডার বেশি হওয়ায় আমি ছোট্ট একটি কারখানার নেই এবং দুটি মেশিন ক্রয় করি। ধীরে ধীরে আমার কারখানা বড় হয় এবং মেশিন সংখ্যা ও লোকবল বাড়তে থাকে। ব্যবসা শুরুর এক বছর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কালার্স হিল নামে একটি বিজনেস পেইজ খুলি। আমার নিজের তৈরি পোশাক অনলাইনে খুব ভালো সাড়া ফেলে। কিছুদিন পর ঢাকার শান্তিনগরে ইস্টার্ন প্লাস শপিং কমপ্লেক্স এ একটি শোরুম নেই। ধীরে ধীরে মার্কেট বুঝতে শুরু করি এবং ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী সরাসরি ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান থেকে পণ্য এনে বিক্রি শুরু করি। আমাদের পণ্যের কোয়ালিটি আমাদের সার্ভিস এবং সততা সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। ব্যবসা শুরুর আগের অনুভূতি নিয়ে তিনি বলেন, তখন আমার কাছে মনে হলো চাকরির পিছে না ছুটে নিজে কিছু করতে পারলে মন্দ হয় না। এতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানও হওয়া সম্ভব। তবে তানিয়ার এই ব্যবসা এতদূর আসা একেবারে সহজ ছিল না। যার প্রথম বাধা ছিল মানুষের মাঝে বিশ্বাস সৃষ্টি করা বলে তিনি মনে করেন। তানিয়া বলেন, আমি যখন অনলাইনে ব্যবসা শুরু করি তখন অনেকেই অনলাইন সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখত না। আমার পরিচিত জনেরা অনেকেই বলেছে তুমি সময় নষ্ট করছো এসব বাদ দিয়ে একটা ভালো চাকরি করো। আমি তাদের বলেছি দেশের বাইরে অনলাইন ব্যবসা অনেক জনপ্রিয়। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে আমাদের দেশেও অনলাইন নির্ভরতা দিন দিন বাড়বে
অনলাইন ব্যবসা শুরুর সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে তানিয়া বলেন, আপনারা জানেন 5 বছর আগে আমাদের দেশে মেয়েদের সোশ্যাল মিডিয়ায় বা পাবলিক প্লেসে বিজনেস করা যথেষ্ট কঠিন ছিল। ফেসবুকে লাইভ করতে অনেক সময় বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে। যা বর্তমানে অনেকটা কমেছে। তবে আমার মধ্যে সবসময়ই একটা জেদ কাজ করে তাহলো- আমাকে পারতে হবে; আমি অবশ্যই পারবো। একজন শিক্ষিত নারী হয়ে তিনি যে উদ্যোগটা নিয়েছেন সেটা শুধু নিজের পরিবারের কথা ভেবে নয়। একজন নারী হিসেবে তিনি অন্য নারীদের কর্মসংস্থাও তৈরী করতে চেয়েছেন। যাতে তাকে সহযোগীতা করেছেন তার স্বামী মনিরুজ্জামান সুমন বলে জানান তিনি। তানিয়া বলেন, ‘করোনার আঘাতে যখন ব্যবসা-বাণিজ্য বিপর্যস্ত তখন কঠোর পরিশ্রম করে টিকে আছি। মহামারীর মধ্যে আমরা একজন কর্মীও ছাঁটাই করি নি। সকলকে সঠিক সময়ে বেতন দিয়ে চালিয়ে নিয়েছি।’ করোনার মধ্যেও কিভাবে টিকে গেল তার ব্যবসা জানতে চাইলে তানিয়া বলেন, ‘আসলে করোনার আগে আমার এক শ্রেনীর ভোক্তা তৈরী হয়েছিল। যেহেতু আমি প্রায় দুই বছর ব্যবসা করতে পেরেছিলাম। তখন আমার পেইজে লাইক ছিল আড়াই লাখের কাছাকাছি। এর মধ্যে অনেকেই আমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। এই ভোক্তারাই আমাকে করোনার সময় অনেক বেশি সাপোর্ট দিয়েছে। তারা লাইভ শেয়ার করছে, বন্ধুদের বলেছে যে এখান থেকে কাপড় কিনুন। আমার কাস্টসাররা ৯৯ ভাগ আমার বিষয়ে পজেটিভ। করোনার মধ্যেও বসে ছিলেন না জানিয়ে তানিয়া বলেন, আমি লকডাউনের মধ্যে একটি দিনও বসে ছিলাম না। যেহেতু অনলাইনে ক্রেতারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছিল। তাই আমি আমার কাজ চালু রেখেছিলাম। বর্তমান সফলতা নিয়ে তানিয়া বলেন, আজ আমার ‘কালার’স হিল’ ফেইসবুক পেইজটি দেশে ও দেশের বাইরের অনেকেই ফলো করছে। ঢাকাসহ দেশের সকল জেলায় এবং উপজেলায় আমাদের প্রোডাক্ট ডেলিভারি দেয়া হচ্ছে। এমনকি বিভিন্ন দেশ থেকে ক্রেতারা অনলাইনের মাধ্যমে আমাদের প্রোডাক্ট ব্যবহার করছে। বর্তমানে আমাদের ৪টি শোরুম আছে ,যার মধ্যে ৩ টি শান্তিনগরের ইস্টার্ন প্লাস শপিং কমপ্লেক্সে এবং ১ টি বসুন্ধরা সিটি শপিংমলে। তানিয়া জানান, ‘যে কোন ব্যবসা শুরু করলে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত আসেই। আমার জন্য পথটা মসৃণ হয়েছে স্বামী মনিরুজ্জামান সুমনের সর্বাত্মক সহযোগিতায়। দুজনের পরিকল্পনা এবং পরিশ্রম আমাদের বর্তমান অর্জনের মূল প্রেরণা। ব্যবসার শুরুতে আমরা তিনটি বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। প্রথমত মান, দ্বিতীয় অনন্য ডিজাইন এবং তৃতীয় হলো- ভোক্তার সন্তুষ্টি। এখন আমরা তিনটি বিষয়ে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি করতে পেরেছি বলে আমরা মনে করি। তার শো-রুমগুলোতে যারা কাজ করছেন তাদের ৬০ শতাংশ নারী বলে জানিয়েছেন তানিয়া। এ নিয়ে তিনি গর্ববোধ করেন বলেও জানিয়েছেন। ভবিষ্যতে আরও বেশি সংখ্যক নারীদের নিয়ে কাজ করতে চান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে আরও বেশি সংখ্যক নারীদের নিয়ে কাজ করতে চাই। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তাই দেশের উন্নয়নে নারীদের যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে বলে আমি মনে করি। তানিয়া ২০০৮ সালে লেখা পড়ার উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন। ২০১৩ সালে মনিরুজ্জামান সুমনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন
© All rights reserved 2000-2025 © kalerchaka.Com
Leave a Reply