শপিংমল গুলোতে ঢুকতেই চোখে পড়বে তরে তরে সাজানো হরেক রকমের দেশী বিদেশী কসমেটিকস। তবে
কোনটি আসল, কোনটি নকল তা পরখ করা বেশ কঠিন। বিদেশী কসমেটিকসের দাপটে দেশীয় কসমেটিকস
সমূহ বর্তমানে কোনঠাসা। বাহারী গেট আপ, উন্নত মোড়ক, কন্টেইনার, প্যাকেট এবং বিজ্ঞাপনের তোড়ে দেশীয়
কসমেটিকস শিল্প এখন অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। কোহিনূর কেমিক্যালস, স্কয়ার টয়লেট্রিজ, মৌসুমী কসমেটিকস,
কেয়া কসমেটিকস এবং মিল্লাত কেমিক্যালসহ হাতে গোনা কয়েকটি দেশীয় কোম্পানীর পণ্য বাজারে রয়েছে।
তবে বাজারের বেশির ভাগ কসমেটিকস ফ্রান্স, তুরস্ক, ভারত, সিংগাপুর, দুবাই, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ
অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশে আসে। বিদেশী কসমেটিকস সমূহ বৈধ পথে আমদানীর চেয়ে চোরাই পথে
লাগেজ পার্টির মাধ্যমে বাজারে প্রবেশ করছে বেশী। ফলে রাষ্ট্র বঞ্চিত হচ্ছে রাজস্ব প্রাপ্তি থেকে।
ট্রেড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে দেশে কসমেটিকস খাতের প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার
বাজার রয়েছে। তৎমধ্যে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রসাধনী আমদানী হয় বাংলাদেশে, বাকী ২৪ হাজার
কোটি টাকার কসমেটিকস প্রসাধনীর বাজার চোরাকারবাীদের দখলে। এর বাইরে ও নকল-ভেজাল নিম্নমানের
কসমেটিকস এর দখলে রয়েছে বিরাট একটি অংশ। নকল ভেজাল নিম্নমানের কসমেটিকস ব্যবহারে কারো মাথার
চুল পড়ে যাচ্ছে, ফর্সা হতে গিয়ে কারো চেহেরার চামড়া সাদা হয়ে যাচ্ছে, কেউ বা আবার স্কীন ক্যান্সার,
বন্ধ্যাত্বসহ লিভার ও কিডনীর নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
গত ১২ই জুন 2024 Johnson & Johnson কোম্পানী তোদের উৎপাদিত বেবী পাউডারে ক্যান্সারের উপাদান
থাকায় আমেরিকার ৪০টি ষ্টেটে ক্ষতিগ্রস্থদের ৭০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ প্রদান করে এবং বাজার থেকে বেবী
পাউডারটি প্রত্যাহার করে নেয়। অনুরূপভাবে Old Spice, Brut, Pantene Ges Uniliver এর পণ্যে
ক্ষতিকর উপাদান থাকায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে তারা বাজার থেকে পণ্য প্রত্যাহার করে নিলেও বাংলাদেশে
তা প্রত্যাহার করতে তেমন একটা দেখা যায় না।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে গার্মেন্টস, ঔষধ, চামড়া, হিমায়িত মৎস্য এবং প্লাস্টিক শিল্পে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে।
দেশের চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে বিশে^ ১৬০ টি দেশে ঔষধ রপ্তানী হচ্ছে। পিছিয়ে পড়া কসমেটিকস শিল্পকে ও
অন্যান্য শিল্পের মতো এগিয়ে নিতে বিগত সরকারগুলো নানান পরিকল্পনা গ্রহন করে। তৎমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে
ঔষধ ও কসমেটিকস আইন-২০২৩। বিগত সংসদে ৭ই সেপ্টেম্বর আইনটি পাস হয়। যা ১৮ই সেপ্টেম্বর ২০২৩
গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়ে কার্যকর হয়। আইনটি প্রণয়ন কালে সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ঔষধ প্রশাসন
অধিদপ্তর (DGDA) এবং বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (BSTI) এর মধ্যে রশি টানাটানি
শুরু হয় BSTI এর দাবী তারা দীর্ঘদিন ধরে পণ্যটি দেখভাল করে আসছে এবং নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্তক্রমে
ইতিপূর্বে কসমেটিকস পণ্যের ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষমতা BSTI কে দেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (DGDA) কসমেটিকস সরাসরি স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত বিধায় আমেরিকা,
কানাডা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, জাপান, ভারতসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশের ড্রাগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা তা নিয়ন্ত্রণ করে
থাকে। তাই সরকার ঔষধ আইন-১৯৪০ কে রদ করে ভারতের আদলে ঔষধ ও কসমেটিকস আইন-২০২৩
প্রণয়ন করে। আইনটি প্রণয়ন কালে বিভিন্ন সময়ে, ইঝঞও ও উএউঅ সহ সকল অংশীজনের মতামত নেওয়া
হয়। ঔষধ ও কসমেটিকস আইন- ২০২৩ এর ২ (৮) ধারায় কসমেটিকস এর সংজ্ঞা এবং পঞ্চম অধ্যায়ের ৩১
৩৫ ধারায় কসমেটিকস এর উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ, লাইসেন্স, নিবন্ধন এবং বিজ্ঞাপন সম্পর্কে বিশদ বিবরণ
রয়েছে। আইনটিতে নকল-ভেজাল কসমেটিকস উৎপাদন ও বাজারজাত কারীদের ৫ বছরের কারাদন্ডসহ ৫ লক্ষ
টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
ইতিমধ্যে আইনটি পাস হওয়ার ১ বছর অতিক্রান্ত হলেও স্বাস্থ্য ঝুকিতে থাকা দেশের বিরাট জনগোষ্টিকে রক্ষা
করতে আইনের কার্যকর প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়নি। এমনকি নকল-ভেজাল কসমেটিকস উৎপাদন,
চোরাকারবারীদের বিরুদ্ধে অভিযান, গ্রেফতার, মামলা বা জরিমানাসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়নি।
ফলে নকল-ভেজাল ও চোরাকারবারীদের দৌরাত্ন দিন দিন বেড়েই চলেছে। BSTI & DGDA এর মধ্যে
রশি টানাটানি বন্ধ করে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে কসমেটিকস শিল্পের উন্নয়নে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ
জরুরী বলে বিজ্ঞ মহল মত প্রকাশ করেন। আন্তর্জাতিক মানের কসমেটিকস ল্যাব, কেমিষ্ট-ফার্মাসিষ্টসহ দক্ষ
জনবল, আইনের সঠিক প্রয়োগসহ যথাযথ পরিকল্পনা থাকলে ঔষধের মতো কসমেটিকসকেও বিশ^ বাজারে
সমাদৃত করে রপ্তানিমূখী খাত হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন ।
লেখক: সাবেক উপ-পরিচালক ও আইন কর্মকর্তা।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
© All rights reserved 2000-2025 © kalerchaka.Com
Leave a Reply