পারভেজ মোশারফ :
কিন্তু যদি তা হয়?জীবন তো সব সময় অনিশ্চিত! তখন কী করবে অদ্বিতীয়া? ”
“আমি আমার সব সম্পত্তি তোমাকে দিয়ে গেলাম কিন্তু মন থেকে দেইনি। এগুলো তুমি ডিসার্ভই করো না। তবু নিয়ম মতো দিলাম। কারণ জীবন তোমাকে যেন অসহায় না করে দিতে পারে। অর্থ কষ্ট বড়ো কষ্ট,এটা থাকলে আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচা যায়।
তবে আমার স্টাডি রুমটা, উপরতলার এই অংশটা আর তোমার সব গানের জিনিসগুলো নিচ তলার মেয়েটাকে দিয়ে দিও। আমি সেভাবেই উইল করে গিয়েছি। আমার শেষ সময়টায় এই মেয়েটাই আমার সাথে ছিল। আর তুমি যা যা করে উঠতে পারোনি, ও তা তা-ই করে উঠতে পারছে। ওরা খুব অভাবের মধ্যে থেকেও আত্মসম্মানটা নষ্ট হতে দেয় নি।
আমার ব্রেইন ক্যান্সার হয়েছে। এবং আমি তা প্রথম স্টেজেই জেনেছিলাম। কিন্তু কোন চিকিৎসা আমি নিইনি,কাউকে বুঝতে দিইনি। বুঝতে দিতে ইচ্ছেও হয়নি। বুঝেছিলাম চিকিৎসা করে যেভাবে বাচঁবো তার চেয়ে এই তো বেশ আছি । জীবন নিয়ে হলো তো অনেক এক্সপিরমেন্ট, আর কত?
আমি আসলে ক্লান্তও হয়ে গিয়েছিলাম। জীবনের প্রতি কোন মোহমায়া আমার কাজ করতো না। যখন মাথার ভিতর ভোঁতা যন্ত্রণাটা বেশি হতো, তখন আমি গাদা গাদা প্যারাসিটামল খেয়ে নিতাম। এতো এতো প্যারাসিটামল খেয়েছি যে,আমার পেটর ভিতর প্যারাসিটামলের একটা গাছও হতে পারত।
তুমি তোমার মেয়েটাকে পারলে সুশিক্ষা দিও।নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখিয়ো। নিজের মতো অপদার্থ বানিয়ো না।
যতটা প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি সাচ্ছন্দ্য দিতে যেওনা। চারটা প্রয়োজন দেখালে একটা দিবে। তবেই অভাববোধের জন্ম হবে, আর সেখান থেকেই সৃষ্টি করা র আশা তৈরি হবে।
না, অদ্বিতীয়া আর পড়তে পারছে না। চোখের পানিতে সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। লেখাগুলোর উপর পানি পড়ে পড়ে তা বড়ো বড়ো হয়ে যাচ্ছে কালি ছড়িয়ে । আজ তার নিজের প্রতি এতো রাগ/অভিমান হচ্ছে যে, যদি আর একটাবার সে মা’কে ফিরে পেতো তবে সব ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে নিতো। কিন্তু সে সুযোগও তো আর নেই। বয়স বেড়ে গেছে অনেকটাই। কীভাবে আবার নতুন করে শুরু করা যায়!
হ্যাঁ, সে আবার গান গাইবে, এই কাজটা সে চাইলেই যে কোন সময় যে কোন বয়সে শুরু করতে পারে। গানটাই হবে তার প্রায়শ্চিত্ত। এই গানটা সে খুব ভালো ভাবেই শিখেছিল।
ছাদের গেইটটায় শব্দ হচ্ছে,কেউ বোধহয় ওকে ডাকছে। সে আস্তে আস্তে মায়ের ঘর থেকে বের হয়ে এলো, গেইটে বুঝি সেই নিচতলার মেয়েটাই দাঁড়িয়ে আছে। অদ্বিতীয়া গেইটটা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলো, “কী নাম তোমার?পদ্ম?”
“আমার নাম পদ্মাবতী। মা,মানে আপনার মা পদ্ম বলে ডাকতেন।”
এই মেয়েটা কত ভাগ্যবতী মা’র সান্নিধ্য পেয়েছিলো !
তুমি গান শিখো?
হুম
কোথায়? শিল্পকলায় নাকি ছায়ানটে?
না,ঘরে বসে বসেই। আর মা’র ইন্টারনেটে ইউটিউব দেখে দেখে।
মা মানে,আমার মা?
হ্যাঁ, মা খুব গান ভালোবাসতেন। আমিও একটু একটু গাইতে পারতাম,তারপর মা’ই আমাকে ইন্টারনেটে গান শিখার ব্যবস্থা করে দেয়। আর আপনার হারমোনিয়াম,তানপুরা দিয়েই শিখতাম।
তুমি কিসে পড়ো?
আমি এইবার ফিফথ ইয়ার মেডিকেলে। মা না থাকলে আমার পড়াশোনাটা বন্ধই হয়ে যেতো। মা’ই আমার পড়ার সব খরচ দিতেন। দাদা বৌদি তো আমাকে আরও ছয় বছর আগেই বিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু মা তা হতে দেয় নি।
অদ্বিতীয়া ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে সামনের মেয়েটার দিকে। আহা! মেয়েটার মুখ থেকে যেন জ্যোতি ঠিকরে বেরুচ্ছে। আর সে, সেই জ্যোতির নিচে পুড়ে ঝলসে যাচ্ছে। নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছে মনে মনে। সে কেন মা’র আদর্শে বড়ো হতে পারলো না? বুকের ভিতরটা যেন মুচড়ে যাচ্ছে,মনে হচ্ছে একটা কাল বৈশাখী ঝড় এসে তার সব কিছুকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দিয়ে গেছে। মনের জানালার এক একটা কাঁচ ভাঙার শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে। নিজের প্রতি ঘৃণা আর লজ্জায় কোনদিন কী সে আয়নায় নিজের এই মুখটা দেখতে পারবে কুৎসিত আর কদাকার এই মুখটাকে ?
পদ্ম তুমি নিচে যা-ও আমি একটু পরে আসবো। আর শোন….
পদ্ম ঘুরে তাকালো প্রশ্ন মনে নিয়ে….
তোমার বাকি পড়াশোনাটা বন্ধ হবে না, আমি দেখবো সেটা।
আরে, না, না আপু, তার আর কোন দরকার নেই। আমার যা দরকার তা চিরতরে হারিয়ে গেছে। যা আপনি কেন আর কেউ কোনদিন ফিরিয়ে দিতে পারবে না, বলে যেন ওড়নার আঁচলে মুখ চেপে ধরলো…….! তারপরে কিছুটা থেমে আবার বললো, এখন আমার টাকার দরকার হয় না । আমি বেশ কয়েকটা স্টুডেন্ট পড়াই,আর একটা কোচিং এ বায়োলজি প্রোগাম চালাই। তাতে অনেক টাকাই আসে, আর দাদা বৌদিও আমাকে এখন অনেক দাম দেয়। মা’ই আমাকে ওদের কাছে এমন দামী বানিয়ে দিয়ে গেছে। আর শিখিয়েছে কীভাবে শিড়দাড়া শক্ত করে বাঁচতে হয়।
অদ্বিতীয়া যেন মরমে মরে যাচ্ছে। এই মেয়েটা কী ইচ্ছে করেই তাকে এসব বলছে? মেয়েটা কী কোনভাবে জানতো যে, তার নিজের মায়ের কাছে সে কতোটা অপদার্থ মেয়ে ছিল? না, জানার তো কথা না, তার মা কোনদিন তার আত্মজা কে অন্যের কাছে ছোট করবে না। তবে? তবে কেন মেয়েটা এভাবে বলছে? ও কী বুঝতে পারছে না তার ভিতরেরর অন্তর্দহনকে?
এমন একটা গরীব ঘরের মা-বাবা মরা মেয়েকে মা বদলে দিয়ে গেলো, আর সে তার পেটের সন্তান হয়ে, সব সুযোগ পেয়েও মা’র স্বপ্নকে ছুঁতে পর্যন্ত পারলো না! আজ আর ডায়েরি খোলার সাহস তার নেই। যা জানলো তার পরে একটা মুহূর্ত সময় নষ্ট করার মতো সময় তার হাতে আর নেই।
অদ্বিতীয়া ঠিক করেই নিয়েছে তার সন্তানদের কীভাবে সে মানুষ করবে, আর গানটা নিয়ে নিজে কীভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। মা’র ইচ্ছেকে পরিপূর্ণতা দিতেই হবে। মা তুমি দেখো আমি পারবো, আমি ঠিক পারবো,পারতে আমাকে হবেই। আমি তোমার অদ্বিতীয়াই হবো,আমি শুধু দিতি হয়ে বাঁঁচবো না মা, অদ্বিতীয়া কাঁদছে, ডুকরে ডুকরে কাদঁছে, গগনবিদারী সে কান্না
© All rights reserved 2000-2023 © kalerchaka.Com
Leave a Reply